প্রাচ্যের নীতিবিদ্যা ও পাশ্চাত্যের নীতিবিদ্যার তুলনা

নেতিবিদ্যা বা ‘এথিক্স’ হল সেই শাস্ত্র যা মানুষের আচরণ এবং কর্মের নৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে চিন্তা করে। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা দুটি ভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং দার্শনিক পরিসরে বিকশিত হয়েছে, যেখানে তাদের মৌলিক ধারণা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। এই প্রবন্ধে আমরা প্রাচ্যের নীতিবিদ্যা ও পাশ্চাত্যের নীতিবিদ্যার মধ্যে ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তুলে ধরব।

১. নির্বাচনের স্বাধীনতা (Individual Autonomy) বনাম সম্পর্কের গুরুত্ব (Relational Ethics)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যার মধ্যে সাধারণত ব্যক্তির স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে “আমি” বা “individual” এর স্বাধীনতা মূল বিষয়। অন্যদিকে, প্রাচ্য নীতিবিদ্যায়, বিশেষত ভারতীয় ও চীনা দর্শনে, সম্পর্ক ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার গুরুত্ব বেশি। সেখানে ব্যক্তির থেকেও বৃহত্তর গোষ্ঠী বা সম্পর্কের কথা ভাবা হয়।

২. কারণ ও ফল (Cause and Effect) বনাম জীবনচক্র (Life Cycle)

পাশ্চাত্যে, নীতিবিদ্যার মধ্যে কারণ-ফল সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া হয়, যেমন কন্টিনিউটি বা নির্দিষ্ট আচরণের ফল কী হবে তা নির্ধারণ করা। প্রাচ্যে, বিশেষ করে হিন্দু দর্শনে, জীবনচক্রের (Reincarnation) ধারণা থেকে নৈতিক মূল্যায়ন করা হয়, যেখানে কর্মের ফল ভবিষ্যতে বা পরবর্তী জন্মে ঘটবে বলে ধারণা করা হয়।

৩. নিজের আত্মরক্ষা (Self-Interest) বনাম পারিবারিক বা সমাজের দায়িত্ব (Family/Social Responsibility)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যায় অধিকাংশ সময় ‘নিজের ভালো’ বা ‘স্বার্থ’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেমন ‘ইগোইজম’ বা ‘ফলসিফায়েড সেলফ-ইন্টারেস্ট’ (ফলসিফায়েড আত্ম-স্বার্থ)। প্রাচ্য দর্শনে, বিশেষত কনফুসিয়ানিজমে, পরিবার বা সমাজের দায়িত্ব পালন এবং হর্মনি বা সামঞ্জস্য রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

৪. আত্মনির্ভরশীলতা (Self-reliance) বনাম পরনির্ভরশীলতা (Dependence on Others)

পাশ্চাত্য দর্শনে আত্মনির্ভরশীলতা ও ব্যক্তিগত সাফল্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেখানে একজন মানুষ তার নিজের উপর নির্ভরশীল। প্রাচ্য দর্শনে, যেমন বৌদ্ধ দর্শনে, পরনির্ভরশীলতা ও পরস্পরের প্রতি সহানুভূতির ধারণা প্রাধান্য পায়।

৫. লৌকিক দায়িত্ব (Secular Duties) বনাম ধর্মীয় দায়িত্ব (Spiritual Duties)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যার মধ্যে লৌকিক বা সামাজিক দায়িত্ব ও নৈতিকতা প্রাধান্য পায়। অন্যদিকে, প্রাচ্য নীতিবিদ্যায় ধর্মীয় কর্তব্য ও আত্মিক উন্নতির পথ অনুসরণ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ভারতীয় নীতিবিদ্যায় ধর্মের প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়া হয়।

৬. অধিকার ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা (Rights and Law) বনাম কর্তব্য ও শৃঙ্খলা (Duty and Discipline)

পাশ্চাত্য দর্শনে সাধারণত অধিকার ও আইনকে শ্রদ্ধা দেওয়া হয়, যেখানে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রাচ্য দর্শনে, বিশেষ করে কনফুসিয়ানিজমে, কর্তব্য ও শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্ব বেশি, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে সামাজিক শৃঙ্খলায় স্থাপন করে।

৭. সাহস ও স্বাধীনতা (Courage and Freedom) বনাম অহংকারের অবগুণ্ঠন (Subduing Ego)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যায় সাহস এবং স্বাধীনতা অর্জনকে মর্যাদা দেওয়া হয়। সেখানে নিজেকে প্রকাশ করার স্বাধীনতা বড় বিষয়। কিন্তু প্রাচ্য নীতিবিদ্যায় অহংকার বা ‘এgo’ কুড়ানোর পরিবর্তে, নিজের স্বত্বাকে সংযত করতে বলা হয়, যাতে ব্যক্তি অহংকারী না হয়ে নিজের আত্মাকে শান্ত রাখতে পারে।

৮. বিশ্বাসের শক্তি (Belief in Reason) বনাম অনুভূতির শক্তি (Belief in Intuition)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যায় সাধারণত যুক্তি ও বিশ্বাসের শক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়। সেখানে নৈতিক সিদ্ধান্তে মস্তিষ্কের বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করা হয়। প্রাচ্য দর্শনে, বিশেষ করে তাওবাদে, অনুভূতি বা অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে নৈতিক সিদ্ধান্তের দিকে যেতে বলা হয়।

৯. অপরাধ ও শাস্তি (Crime and Punishment) বনাম করুণার গুরুত্ব (Compassion and Forgiveness)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যায় অপরাধ করলে শাস্তির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে আইনের শাসন খুবই শক্তিশালী। প্রাচ্য দর্শনে, যেমন বৌদ্ধ দর্শনে, করুণা ও ক্ষমার গুরুত্ব বেশি। অপরাধের পরিবর্তে মনের দয়াশীলতা এবং ক্ষমার মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়।

১০. স্বার্থপরতা (Selfishness) বনাম পরার্থপরতা (Selflessness)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যায়, ‘স্বার্থপরতা’ কখনও কখনও নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যদি তা ব্যক্তির স্বার্থের জন্য হয়। প্রাচ্য নীতিবিদ্যায়, যেমন বৌদ্ধধর্মে, ‘পরার্থপরতা’ বা নিজেকে বিসর্জন দেওয়া অধিক মূল্যবান।

১১. পৃথক পরিচয় (Individual Identity) বনাম ঐক্য (Unity with Nature)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যায় ব্যক্তির পরিচয় এককভাবে গড়ে ওঠে, যেখানে ব্যক্তি তার স্বতন্ত্রতা প্রাধান্য পায়। প্রাচ্য নীতিবিদ্যায়, বিশেষ করে তাওবাদে, প্রকৃতির সঙ্গে ঐক্যের ধারণা শক্তিশালী। মানুষ এবং প্রকৃতি একে অপরের অংশ বলে মনে করা হয়।

১২. স্বাধীনতা ও ন্যায় (Freedom and Justice) বনাম সাম্য ও হর্মনি (Equality and Harmony)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যার মূল লক্ষ্য স্বাধীনতা এবং ন্যায়ের মধ্যেই সুষমতা খোঁজা। প্রাচ্য দর্শনে, বিশেষ করে কনফুসিয়ানিজম ও তাওবাদে, সাম্য ও হর্মনির দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়, যেখানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার চেয়ে সামাজিক সম্মিলন এবং সুশৃঙ্খলতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

১৩. আত্মমুখী (Self-Centered) বনাম পরমুখী (Other-Centered)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যায় ব্যক্তি তার নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, যেখানে নিজের অনুভূতি এবং প্রয়োজন সবচেয়ে বড় বিষয়। প্রাচ্য নীতিবিদ্যায়, ব্যক্তির নিজস্ব স্বার্থকে পরিহার করে, অন্যের কল্যাণের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়।

১৪. ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) বনাম ধর্মীয় জীবন (Religious Life)

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যায় ধর্ম এবং দুনিয়ার মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও, প্রাচ্যে ধর্মীয় জীবন এবং দুনিয়া একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

১৫. মুখ্য সত্য (Objective Truth) বনাম আপেক্ষিকতা (Relativism)

পাশ্চাত্য দর্শনে সত্যের একটি নির্দিষ্ট ও অটুট দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। অন্যদিকে, প্রাচ্য দর্শনে, বিশেষত চীনা দর্শনে, সত্য আপেক্ষিক বা পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল হতে পারে।

উপসংহার

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা একে অপরের থেকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ ধারণ করে। প্রাচ্য দর্শন সাধারণত সম্পর্ক, সমতা, আত্মসংযম ও সামাজিক দায়িত্বের প্রতি অধিক মনোযোগ দেয়, যেখানে পাশ্চাত্য দর্শন ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, আত্মনির্ভরশীলতা এবং অধিকারকে প্রাধান্য দেয়। তবে, উভয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই রয়েছে মানবতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, যা তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধের ভিত্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *