প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু উঠেছে; রাজনীতির রথে অর্থনীতি কোথায়?

প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু উঠেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্জণে আরেকটি উজ্জল মাইল ফলক। নিশ্চিতভাবে এটি দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্যি যে, পদ্মা সেতু নিয়ে যে পরিমান রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বা বয়ান হচ্ছে সে তুলনায় অর্থনৈতিক দিকটা বেশ উপেক্ষিত। যদিও পদ্মা সেতুর রাজনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে অর্থনৈতিক গুরুত্ব ঢের বেশি।

    নূর আলম

এদেশে যে কোন বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক বয়ানে যুক্ত হওয়া বেশ সহজ। কারন, এর জন্য গ্রহণযোগ্য কোন যুক্তির প্রয়োজন হয় না, দরকার পড়ে না ভ্যালিড কোন তথ্যের। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে প্রতিটি বয়ান এক একজন মুনির মতে পরিণত হয়। নানা মুনির নানা মতের বয়ানগুলো সত্য মিথ্যার মিথষ্ক্রিয়ায় মাধ্যমে শক্তিশালী ন্যারেটিভ বা অবান্তর সত্যের জন্ম দেয়। যেমন, কেউ একজন চাইলেই সরকার প্রধাণ বা ক্ষমতাসীন দল নিয়ে যে কোন গুজব রটিয়ে দিতে পারে। 

এজন্য প্রকৃত কোন তথ্য বা গ্রহণযোগ্য কোন যুক্তির প্রয়োজন নেই। কারন, এ ধরনের গুজব বিশ্বাস করার জন্য লক্ষ জনতা মুখিয়ে আছে। মুদ্রার ওপিঠে একই বিষয় ঘটে থাকে। ক্ষমতার বাইরে যারা আছে ,চাইলে তাদের চেহারায়ও সহজে কালিমা লেপন করা যায়, এটি অধিকতর সহজ। কারন, ক্ষমতার ছত্রছায়ার বয়ানগুলোতে চাইলেই নিকৃষ্টতম ভাষা চরম মিথ্যার ব্যবহার করা যায়। রাজনৈতিক বয়ানের এমন সহজলভ্যতার কারনে ঘাটে ঘাটে অবহেলিত ও অনাদৃত হচ্ছে অর্থনীতি ও এর ধারক বাহকরা।

প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু উঠেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্জণে আরেকটি উজ্জল মাইল ফলক। নিশ্চিতভাবে এটি দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্যি যে, পদ্মা সেতু নিয়ে যে পরিমান রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বা বয়ান হচ্ছে সে তুলনায় অর্থনৈতিক দিকটা বেশ উপেক্ষিত। যদিও পদ্মা সেতুর রাজনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে অর্থনৈতিক গুরুত্ব ঢের বেশি। এ দেশে রাজনৈতিক বয়ানে যুক্ত হতে জ্ঞানের চেয়ে দাপটই বেশি কার্যকর। সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো কৌশলগত কারনে বা অজ্ঞনতার কারনে পদ্মা সেতুর অর্থনৈতি আলাপ থেকে বেশ দূরে অবস্থান করছে। আশ্চর্যজনকভাবে সরকার , মন্ত্রণালয় বা সরকারের সমর্থক গোষ্ঠীও পদ্মার সেতুর অর্থনৈতিক আলাপে তুলনামূলক কম আগ্রহী। কিছু আলাপে জিডিপিতে পদ্মা সেতুর অবদানের কথা উঠে এসেছে। কিন্তু জিডিপিতে অবদানের মোটা হিসেবের বাইরেও পদ্মা সেতু অনেক ধরনের অর্থনৈতিক তাৎপয বহন করে।

প্রথমটি হল নিজস্ব অর্থায়নে বা জনগনের টাকায় সেতু তৈরি। নিজস্ব অর্থায়নে যে কোন বড় বাজেটের প্রকল্প বাস্তবায়নের কয়েকটি মৌলিক সুবিধা রয়েছে, সেগুলো হল- বিদেশী অর্থায়নে দীর্ঘ মেয়াদে মোটা অংকের সুদ গুনতে হয়, নিজস্ব অর্থায়ানের ক্ষেত্রে সেটি নেই, দাতা সংস্থাগুলো যে কোন বড় প্রকল্পে অর্থায়নের আগে অনেকগুলো কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়, এগুলো বাস্তবায়ন একদিকে যেমন কঠিন অন্য দিকে দেশের জন্য প্রায়ই ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়। আমরা কোন শর্তের বলি না হয়ে পদ্মা সেতু করতে পেরেছি , এটি অনন্য দিক। জনগনের টাকায় মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে যে কোন ক্ষতির দিক নেই তা কিন্তু না। ক্ষতির দিকটি হচ্ছে বড় প্রকল্পে ব্যয়িত অর্থের সুযোগ ব্যয়। উন্নয়নশীল দেশে নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় প্রকল্প করা মানে অর্থ বাজারে চাপ তৈরি করা, ব্যাংকিং সেক্টরের বিনিয়োগ ক্ষমতা হ্রাস করা। সহজ করে বললে, যে পরিমান টাকা এখানে খরচ হয়েছে সে পরিমান টাকা দিয়ে সরকার অনেক অবকাঠামো, কৃষি-শিল্প বা সৃজনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যয় করতে পারত। এখানে একটি বিষয় অবশ্যই বোধগম্য যে , পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণের ২১ টি জেলায় কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এর মূল্য কম নয়। তবে, এটি নির্ভর করবে তৈরি হওয়া সম্ভাবনাগুলোতে আমরা কিভাবে কাজ লাগাতে পারি তার উপর।

সম্ভাবনাগুলোকে ঠিকমত কাজে লাগাতে না পারলে সঠিক সুফলটি আমরা পাব না। একটি উদাহরণ দিচ্ছি, নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অধিক সংখ্যক মানুষ এখন কুয়াকাটায় সুর্যাস্ত দেখার জন্য ভীড় করবে। কুয়াকাটা কেন্দ্রিক অনেক অবকাঠামো গড়ে উঠবে। পর্যটন খাতে প্রবৃদ্ধি হবে। এখানে প্রয়োজন হবে সঠিক সরকারি পরিকল্পনা এবং সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগগুলোর সঠিক সমন্বয়। এক্ষেত্রে যত্র তত্র অবৈধ স্থাপনা গড়তে দেয়া যাবে না, পর্যটন খাতকে কথিত সিন্ডিকেটের হাত থেকে দূরে রাখতে হবে। আমাদের আরেকটি গর্ব সুন্দরবনকে ঘিরে গড়ে উঠবে আরেকটি পর্যটন জোন। এখানে চ্যালেঞ্চটি হবে পরিবেশ ও পর্যটনের মধ্যে ভারসম্যটি রক্ষা করা। দক্ষিনের কৃষি এবং শিল্পে বড় বিনিয়োগ এখন সময়ের দাবি। একই সাথে নিশ্চিত করতে হবে জ্বালানি ও কাঁচামাল।

এতগুলো জিনিস করতে হবে বলছি ; এর পেছনের কারনটি দৃশ্যমান। কারনটি হল বিভিন্ন মহল থেকে পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে রাজনৈতিক গুরুত্বকে সামনে আনা হচ্ছে বেশি করে। এটিই শংকার জায়গা। 

পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষ্যে যে পরিমান টাকা খরচ করে প্রচার-প্রচারণা ও উৎসব আয়োজন হয়েছে দেশ ব্যাপি, এর একটা অংশ দিয়ে হয়ত অনেক গ্রাম বা ইউনিয়নের প্রায় পরিত্যাক্ত রাস্তা সংস্কার করা যেত। পদ্মা সেতুর প্রচারণায় ব্যয়িত অর্থ দিয়ে হয়ত কোন বিচ্ছিন্ গ্রামকে সংযুক্ত করা মূল ভুখন্ডের সাথে। এ টাকা বিনিয়োগ করে হয়ত অর্থনীতির প্রাণশক্তি কৃষকের জীবনটা আরেকটু সহজ করা যেত। 

জনগনের টাকা খরচ করে নির্মিত পদ্মা সেতু থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সকল পক্ষকে কার্যকর ভূমিকাটি রাখতে হবে।পদ্মা সেতুতে কে আগে উঠতে পারল এ ধরনের হাস্যকর ও শিশুসুলভ বিষয় নিয়ে ব্যস্ততা বাদ দিয়ে এর সঠিক ব্যবহারে মনোযোগী হওয়া জরুরী। এদেশে নানা মতের মানুষের বসবাস। মত যা ই হোক না কেন, জনগনের কষ্টার্জিত টাকায় যে পথ তৈরি হয়েছে সেটির রথে সবার অংশগ্রহণ জরুরী।

লেখক,

নূর আলম 

বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ময়মনসিংহ), ব্রাক

Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author

If you want to share your thought, you can mail us at: edior.sot@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *