পাশ্চাত্য ও ভারতীয় নীতিবিদ্যার সমালোচনা

নীতিবিদ্যা বা Ethics হলো মানুষের ভালো ও মন্দ, সঠিক ও ভুল, ন্যায় ও অন্যায় বিষয়ে চিন্তা ও মূল্যায়নের বিজ্ঞান। এটি সমাজের নৈতিক মানদণ্ড গঠন করে এবং মানবিক আচরণে ন্যায়-অন্যায়ের সীমানা নির্ধারণ করে। তবে, পাশ্চাত্য ও ভারতীয় নীতিবিদ্যার মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দৃষ্টিকোণকে আলাদা করে। এই নিবন্ধে আমরা পাশ্চাত্য ও ভারতীয় নীতিবিদ্যার সমালোচনা করব এবং তাদের মধ্যে মিল এবং অমিল তুলে ধরব।

১. পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যার সমালোচনা:

পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা মূলত রেসনালিজম, ইন্ডিভিজুয়ালিজম এবং কন্ট্রাক্টুলিজমের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে সক্রেটিস, প্লেটো, এবং অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারা থেকেই পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যার সূচনা। এই চিন্তাধারা মানব আচরণের মধ্যে রাশনাল চিন্তা ও যুক্তির উপরে গুরুত্ব দেয়।

1. ইন্ডিভিজুয়ালিজমের প্রবণতা: পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যায় ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা কখনো কখনো সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নৈতিক স্বাধীনতা অধিক গুরুত্ব পেলে সমাজের প্রয়োজনীয়তা বা দায়িত্বের প্রতি অবহেলা হতে পারে।

2. অন্তর্নিহিত সত্তা বা ইউটিলিটের প্রতি একতরফা মনোযোগ: পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা প্রায়ই ফলাফলের দিকে মনোযোগ দেয় (যেমন ইউটিলিটারিয়ানিজম)। তবে, কখনো-কখনো এটি নৈতিকতার মৌলিক নীতিগুলির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করতে পারে, যেমন একজন মানুষের অধিকার এবং তার মর্যাদার প্রতি সম্মান।

3. অবিচার এবং বৈষম্য: পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা কখনো সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য এবং অবিচারের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এতে কিছু বিশেষ শ্রেণির মানুষের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন অব্যাহত থাকতে পারে।

২. ভারতীয় নীতিবিদ্যার সমালোচনা:

ভারতীয় নীতিবিদ্যা দীর্ঘকাল ধরে হিন্দু দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন, এবং জৈন দর্শনের প্রভাবের অধীনে গড়ে উঠেছে। ভারতীয় নীতিবিদ্যার মূল তত্ত্বগুলি হলো ধর্ম (Dharma), কর্ম (Karma), এবং মোক্ষ (Moksha)। এই দর্শনে মানুষের নৈতিক দায়িত্ব মূলত তার ধর্ম বা জীবনধারার সাথে সম্পর্কিত।

1. ধর্মের ব্যাপকতা: ভারতীয় নীতিবিদ্যার ধর্ম বা ধর্মের ধারণা কখনো কখনো অত্যন্ত জটিল ও স্থানীয় রীতির উপর নির্ভরশীল। ফলে, এটি সর্বজনীন ন্যায়ের ধারণার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।

2. অন্তর্নিহিত গুণাবলী এবং আত্ম-উন্নতি: ভারতীয় নীতিবিদ্যায় আত্ম-উন্নতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা কখনো কখনো সামাজিক ন্যায় বা বৈষম্য মোকাবিলার ক্ষেত্রে সীমিত হতে পারে। এটি ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি এবং মোক্ষ লাভের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়।

3. বিশ্বব্যাপী ন্যায়ের অভাব: ভারতীয় নীতিবিদ্যায় কখনো কখনো বিশ্বব্যাপী ন্যায়ের কথা কম বলা হয়েছে। এতে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে উঠে এসেছে, যা বৃহত্তর বৈশ্বিক ন্যায়ের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

৩. তুলনা ও পর্যালোচনা:

ন্যায় ও দায়িত্ব: পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা সাধারণত ব্যক্তি স্বাধীনতা ও যুক্তির ওপর গুরুত্ব দেয়, তবে কখনো কখনো এটি সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ভারতীয় নীতিবিদ্যা ব্যক্তির ধর্ম এবং তার কাজের ওপর মনোযোগ দেয়, তবে কখনো কখনো এটি ন্যায়ের সার্বজনীন ধারণার পরিপন্থী হতে পারে।

বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি: পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা সাধারণত ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং যুক্তির ওপর নির্ভরশীল, যা বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ভারতীয় নীতিবিদ্যা জীবনের আদর্শ ও মোক্ষ লাভের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়, যা কিছু ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম হতে পারে।

সমাজের প্রতি দায়িত্ব: পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যার একক দৃষ্টিভঙ্গি কখনো কখনো সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের দিকে দৃষ্টিপাত করতে ব্যর্থ হয়। ভারতীয় নীতিবিদ্যা ধর্মের মধ্য দিয়ে সমাজের প্রতি দায়িত্ব নির্ধারণ করে, তবে এতে বিশ্বজনীনতার অভাব থাকতে পারে।

উপসংহার:

পাশ্চাত্য ও ভারতীয় নীতিবিদ্যার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকলেও, উভয়ই মানবিক আচরণ, ন্যায়, এবং কল্যাণের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনা উপস্থাপন করেছে। পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা যেখানে যুক্তি এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয়, ভারতীয় নীতিবিদ্যা সেখানে আত্মিক উন্নতি এবং ধর্মের দিকে বেশি মনোযোগী। তবে, প্রতিটি দর্শনই আধুনিক বিশ্বে প্রাসঙ্গিক এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় গঠন করতে পারলে আরও উপকারী হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *