পাবলিক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হলেই কি বাজে মন্তব্য পেতে হবে?

“এধরনের মন্তব্যকারী ইদানীং বেশ দেখা যায় সেটা হলো, অনেক বেশি ভিউ পাওয়া পোস্টগুলোতে যেয়ে যারা বাজে কথা লিখে নিজেকে রসবোধসম্পন্ন প্রমাণ করতে চায় তাদের বন্ধুমহলে।”

তাসনুভা আলম অহনা

পনি নিশ্চয়ই অন্তত একটি হলেও সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট ব্যবহার করেন? জোর সম্ভাবনা আছে যে এই লেখাটিও আপনি কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেই পড়ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোটামোটি নিয়মিত হলে যেকোন পাবলিক কন্টেন্টের নিচে কিছু মন্তব্য হরহামেশাই দেখতে পাবেন, যেগুলোর বেশিরভাগ জুড়েই থাকে অকথ্য ভাষার গালিগালাজ। আপনি নিজে কোন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হয়ে থাকলে প্রবল সম্ভাবনা আছে আপনি নিজেও এর শিকার হয়েছেন, অথবা অন্ততপক্ষে এমন মন্তব্যগুলো আপনার সামনে পরেছে। কিন্তু কেন? কাউকে অনলাইনে একটা মন্দ কথা লিখে আসলে কি পাওয়া যায়, আর যারা এসব লেখে থাকেন, তারাই বা কিসের আশায় এমন কাজ করেন? এক্ষেত্রে সহজ একটা ব্যাখ্যা হতে পারে যে হয়তো সেসব কন্টেন্টেই এমন কিছু থাকে যাতে মানুষ সেগুলো দেখে বা পড়ে এমনভাবেই তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে বাধ্য হয়।

কিন্তু এই সহজ ব্যাখ্যাটায় আটকে না থেকে সরেজমিনে দেখতে গেলেই বোঝা যায় যে এই ব্যাখ্যাটা সহজ হলেও অনেক ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক। কারন, কোন নায়িকার জীবনে ঘটে যাওয়া কেলেংকারি থেকে শুরু করে, ইংরেজি শেখানোর ভিডিও, কোন রান্না বা মেকাপের টিউটরিয়াল অথবা মজা করেই বানানো কোন স্কিট (স্ক্রিপ্টেড হাস্যরসাত্মক ভিডিও); বিষয় যেটাই হোক না কেন, মন্তব্যে গালি-গালাজ আপনি খুঁজে পাবেনই। অনেকসময়ই সেটা কন্টেন্টের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও মানুষকে এমন মন্তব্য করতে দেখা যায়। 

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এধরনের মন্তব্য আপনি সচরাচর এমন কোন পোস্টে পাবেন না, যেটা কিছু নির্দিষ্ট গন্ডির মাঝে সীমাবদ্ধ অর্থাৎ ব্যক্তিগত পোস্ট যেগুলো আপনার বন্ধুবান্ধব, কলিগ বা আত্মীয়স্বজন ছাড়া কেউ দেখছেনা। 

তাহলে সেই একই ধরনের কন্টেন্ট পাবলিক করলেই কেন প্রতিক্রিয়া এতটা ভিন্ন হয়ে যায়? তার মানে কি পাবলিক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হতে হলেই এমন মন্তব্য পেতে অভ্যস্ত হতে হবে? আর কোন কোন ক্ষেত্রেই বা এসব মন্তব্য এসে থাকে, তার কারনই বা কি, আসুন বোঝার চেষ্টা করি।

১। ‘অডিয়েন্স ইজ অলওয়েজ রাইট’ মানসিকতাঃ 

কেউ যখন পাব্লিক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন তার একটা আলাদা পরিচয় মানুষের কাছে তৈরি হয়ে যায়। আমরা তখন “অডিয়েন্সইজ অলওয়েজ রাইট”- এই ধারণা মাথায় নিয়ে ফেলি, কেউ পাবলিক কন্টেন্ট প্রকাশ করলেই আমাদের মনস্তত্তে কাজ করে যে এই ব্যক্তির প্রধাণ দায়িত্ব আমাদের মনোরঞ্জন করা এবং কোনভাবে তার কাজের সামান্যতম অংশেও যদি সেই উদ্দেশ্য সফল না হয়, তাহলেই একটা বাজে মন্তব্য করে ফেলাটা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাই সমালোচনা করতে যেয়ে আমরা বাজে কথা কিছু কম বলতে ছাড়িনা। অথচ যেই সমালোচনাটা হয়তো আর ভদ্রভাবে সহজেই করা যেত। 

২। পূর্বনির্ধারিত ধারনার ব্যত্যয়ঃ

সবসময় যে তাদের কন্টেন্টের ওপর ভিত্তি করেই মন্তব্যগুলো করা হয় তা নয়। অডিয়েন্স এর মানসিকতায় তাদের অনেক পছন্দের কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের একটা চরিত্র চিত্রিত হয়ে যায় এবং তারা তাকে তাদের সেই ভেবে নেওয়া প্রতিচ্ছবির বাইরে দেখতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেনা। 

ধরা যাক কোন ক্রিয়েটর তার পোস্টটি দিয়েছেন কোন একটা ধর্মীয় আচার পালনের সময়, অথবা কোন ক্রিয়েটরের পরিহিত পোশাক সেই অডিয়েন্স পছন্দ করছেন না, বা কোন ক্রিয়েটর তার কোন ব্যক্তিগত মতাদর্শের কথা তার পাবলিক প্লাটফর্মে প্রকাশ করেছেন যা সেই দর্শক ভালোভাবে নেননি- এমন সব নানা ধরনের বিষয় হতে পারে দর্শকের এমন প্রতিক্রিয়ার উৎস। 

৩। সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্সঃ

অনেক সময় কোন পাবলিক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর যদি আগে থেকেই বেশ গ্রহনযোগ্য অবস্থায় থাকেন তার দর্শকদের কাছে, সেক্ষেত্রেও তার ব্যাপারে কোন নেগেটিভ খবর ছড়ালে মানুষ তুলনামুলক ভাবে বেশি পরিমাণে বাজে মন্তব্য করে থাকে। কারন, এধরনের মানুষদের অনেক ভক্ত থাকলেও, সেই ভক্তরা যখন তাদের কোন নেগেটিভ কিছু জানতে পারে, তাদের মধ্যে অজান্তেই একটা সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স চলে আসে। এবং সেক্ষেত্রে সেই ভক্তরা নিজেদেরকে একটা বিচারকের আসনে বসিয়ে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাঠগড়ায় দাড় করাতে চায়। 

অবচেতনভাবেই তাদের নিজেকে নিয়ে ভালো অনুভূতি সৃষ্টি হয় এবং এই কাজটা করে সেই মন্তব্যকারীরা নিজেদেরকে সমাজসংস্কারকের ভূমিকায় দেখতে শুরু করে। 

৪। মনোযোগ আকর্ষণঃ

এধরনের মন্তব্যকারী ইদানীং বেশ দেখা যায় সেটা হলো, অনেক বেশি ভিউ পাওয়া পোস্টগুলোতে যেয়ে যারা বাজে কথা লিখে নিজেকে রসবোধসম্পন্ন প্রমাণ করতে চায় তাদের বন্ধুমহলে। এর পেছনে সম্পূর্ণভাবে এটেনশন গ্র্যাবিং টেন্ডেন্সি কাজ করে, যেটা তুলনা করা যায় ছোট বাচ্চারা দুষ্টুমি করে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাওয়ার সাথে। আর যেখানে মনোযোগ আকর্ষণটাই মূল উদ্দেশ্য, কোন পাবলিক পোস্টই হতে পারে তার সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা। শুধু তাই নয়, এধরনের মন্তব্য করে অনেকে সেই পোস্টদাতার দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে চায় যেটা আরো একটি শিশুসুলভ ব্যবহারের সাথে তুলনা করা যায় যখন ছোট বাচ্চারা খেলতে গিয়ে সঙ্গীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে যেয়ে বেনি ধরে টানে। 

৫। কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের সহজলভ্যতাঃ

তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই, কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের হতে হয় সহজলভ্য, অর্থাৎ, তাদের কন্টেন্ট ফেসবুক, ইউটিউব এসব মাধ্যমে চাইলেই সহজেই পাওয়া যায়। আর একারনে, বাজে মন্তব্যকারীদের জন্য সেসব কন্টেন্ট খুঁজে পাওয়া আর সেখানে নিজের বাজে মন্তব্যটি রেখে যাওয়া হয় তুলনামূলক সহজ। তাই, সাধারন মানুষের চেয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটরকেই এধরনের মন্তব্য বেশি সহ্য করতে হয়।

৬। স্ট্রেস রিলিফঃ

অনেকে থাকেন যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এধরনের মন্তব্য করতে ভুয়া একাউন্ট ব্যবহার করে থাকেন, তারা বিষয়টাকে একটা উত্তেজনাপূর্ণ এবং মজার বিষয় হিসেবে দেখেন। তারা যেকোন জায়গায় গিয়ে একটা ভুয়া একাউন্ট ব্যবহার করে দরকার না থাকলেও বাজে মন্তব্য করে আসেন, এবং এই দলের মধ্যে সমাজের একদম নিম্নস্তরের মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চস্তরের ভদ্র ঘরের মানুষও প্রচুর থাকেন। এই কাজটা করে তারা এক ধরনের স্বস্তি বোধ করেন যেকারনে বারবার তারা একই পথে পা বাড়ান।

তবে কারন বা পেছনের উদ্দেশ্য যাই হোক, বাজে মন্তব্য পেতে কারোই ভালো লাগেনা, সেটা পরিচিত কারো কাছ থেকে আসুক বা অপরিচিত। এধরনের মন্তব্য করার বিষয়টাও সাইবার বুলিং এবং স্ল্যান্ডার বা মানহানি এর আওতায় ফেলা যায়। তাই পরবর্তীতে এমন কিছুর শিকার হলে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন সাইবার ক্রাইম বিভাগের সাথে। 

শিক্ষার্থী

সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

যোগাযোগঃ ahonatasnuva@gmail.com

সাইবার-বুলিং ও সচেতনেতা নিয়ে স্কুল অফ থটের তৈরিকৃত ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন- Cyber Bullying: Make Internet Safer

The writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author. 

If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *