পাওলোফ্রেইরে’সক্রিটিক্যালপেডাগোজি: তত্ত্বএবংপ্রয়োগ

ভূমিকা
পাওলো ফ্রেইরে (Paulo Freire) ব্রাজিলিয়ান দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ, যিনি বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ও উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার তত্ত্ব ক্রিটিক্যাল পেডাগোজি (Critical Pedagogy) আজকের শিক্ষা ও সমাজের প্রসঙ্গে একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ধারণা হয়ে উঠেছে। ফ্রেইরের শিক্ষা দর্শন মূলত ক্ষমতা, শ্রেণী, এবং জাতিগত বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে, এবং এটি শিক্ষাকে সামাজিক পরিবর্তন এবং মুক্তির একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। তার তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাকে একপেশে, শাসক শ্রেণীর উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি প্রক্রিয়া না হয়ে জনগণের ক্ষমতায়ন এবং মুক্তির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা করা। এই লেখায়, আমরা ফ্রেইরের ক্রিটিক্যাল পেডাগোজি তত্ত্বের মূল ধারণা এবং এর প্রয়োগের আলোচনা করব।

পাওলো ফ্রেইরের ক্রিটিক্যাল পেডাগোজি তত্ত্ব

ফ্রেইরে’স ক্রিটিক্যাল পেডাগোজি মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষের জন্য শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার একটি আন্দোলন। তার মতে, শিক্ষা শুধুমাত্র তথ্য বা জ্ঞান পরিবেশন নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যেখানে শিক্ষক এবং ছাত্র একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করে। ফ্রেইরের তত্ত্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো:

১. শোষণমূলক শিক্ষা এবং অবচেতন মন

ফ্রেইরে তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই “পেডাগোজি অফ দ্য অপপ্রেসড” (Pedagogy of the Oppressed)-এ বলেন, যে শিক্ষা প্রথাগতভাবে পরিচালিত হয় তা প্রায়ই শাসক শ্রেণীর উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। সমাজের নিম্নশ্রেণী বা শোষিত জনগণের পক্ষে এই ধরনের শিক্ষা উপকারী নয়। এর মধ্যে, শিক্ষকদের একপেশে ক্ষমতা এবং ছাত্রদের মধ্যে শাসক শ্রেণীর প্রতি আনুগত্য তৈরি করার প্রবণতা থাকে। এর ফলে, শিক্ষার্থীরা তাদের অবস্থা ও সমাজের প্রতি নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন না হয়ে বেড়ে ওঠে। ফ্রেইরে বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে নিজের ক্ষমতার প্রতি সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে তারা তাদের শোষিত অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

২. ডায়ালেকটিকাল শিক্ষা প্রক্রিয়া

ফ্রেইরে’র শিক্ষা তত্ত্বে “ডায়ালেকটিকাল প্রক্রিয়া” (dialectical process)-এর ওপর গুরুত্ব দেয়। তার মতে, শিক্ষা একটি একতরফা প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি একটি দ্বিমুখী এবং অভ্যন্তরীণ সংলাপ। শিক্ষক এবং ছাত্র একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারে এবং নিজেদের চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানের স্থানান্তরের মাধ্যমে একটি সমতাভিত্তিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। এই তত্ত্বের মূল লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের অংশগ্রহণমূলক শিক্ষার মাধ্যমে তাদের মুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে আসা, যেখানে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান মূল্যবান হিসেবে গণ্য হয়।

৩. শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে সমতা এবং পারস্পরিক শিখন

ফ্রেইরে বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষকের ভূমিকা শুধু তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। শিক্ষকদের অবশ্যই ছাত্রদের সহায়ক, সহযাত্রী এবং চিন্তাশীল গাইড হিসেবে কাজ করতে হবে। শিক্ষকরা ছাত্রদের চিন্তাভাবনার বিকাশে সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে, তবে ছাত্ররা তাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা এবং চিন্তাভাবনাও শিক্ষার অংশ হিসেবে আনে। এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে সাহায্য করে।

৪. শিক্ষাকে মুক্তির মাধ্যম হিসেবে দেখা

ফ্রেইরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল শিক্ষাকে “মুক্তির প্রক্রিয়া” হিসেবে দেখা। তার মতে, শিক্ষা শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি সমাজের শোষিত জনগণের জন্য এক ধরনের মুক্তির পদ্ধতি। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তাদের শোষিত অবস্থান এবং সমাজের প্রতি তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়ে, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। এজন্য, তিনি শিক্ষার মাধ্যমে জনগণের অধিকার এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।

ক্রিটিক্যাল পেডাগোজির প্রয়োগ

ফ্রেইরে’র ক্রিটিক্যাল পেডাগোজির ধারণা কেবল তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাস্তব শিক্ষাব্যবস্থায়ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। তার তত্ত্বের প্রয়োগ কীভাবে সমাজে পরিবর্তন আনতে সাহায্য করেছে তা বোঝার জন্য আমাদের কিছু উদাহরণ দেখা যেতে পারে:

১. গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার প্রসার

ফ্রেইরে প্রথমে ব্রাজিলের গ্রামাঞ্চলে তার শিক্ষণ পদ্ধতি কার্যকর করতে শুরু করেন, যেখানে লেখাপড়ার হার অত্যন্ত কম ছিল। তার পদ্ধতি অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং সমাজের নানা সমস্যার সম্পর্কে আলোচনা করতে পারত। এর ফলে, গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা তাদের সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে আরও সচেতন হতে শুরু করে এবং সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত হয়।

২. আঞ্চলিক বা জাতিগত ভাষা ব্যবহার

ফ্রেইরে তার শিক্ষাদর্শনে গুরুত্ব দিয়েছেন আঞ্চলিক বা জাতিগত ভাষার ব্যবহারের দিকে। তার মতে, যে ভাষায় ছাত্ররা স্বচ্ছন্দভাবে চিন্তা করতে পারে, তা ব্যবহারের মাধ্যমে তারা নিজেদের ভাবনা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করতে পারে। এভাবে, শিক্ষা আরও প্রাসঙ্গিক এবং সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। এটি জনগণের চিন্তা-ভাবনা ও অভিজ্ঞতাকে মূল্য দেয় এবং তাদের ক্ষমতায়ন করে।

৩. জনগণের অধিকার এবং ক্ষমতায়ন

ফ্রেইরে’র ক্রিটিক্যাল পেডাগোজি শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং তাদের সমাজে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট করে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাজিলের শিক্ষকরা তার পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের শিক্ষার্থীদেরকে রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। তারা শুধুমাত্র গনতান্ত্রিক শিক্ষার দিকে আগ্রসর হয়ে, সমাজের শোষণমূলক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে শেখেন।

পাওলো ফ্রেইরের ক্রিটিক্যাল পেডাগোজি তত্ত্বের গুরুত্ব

ফ্রেইরে’র ক্রিটিক্যাল পেডাগোজি একটি মুক্তিযুদ্ধের পদ্ধতি, যেখানে সমাজের নিচুতলা জনগণ তাদের ক্ষমতা এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। তার তত্ত্ব সমাজের জনগণের মাঝে আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে সহায়তা করেছে। এছাড়া, তার পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের কেবলমাত্র পাঠ্যবইয়ের বাইরের জীবন-অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয় এবং শিক্ষাকে একটি সক্রিয় এবং পারস্পরিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে সাহায্য করেছে।

উপসংহার

পাওলো ফ্রেইরের ক্রিটিক্যাল পেডাগোজি তত্ত্ব সমাজে শিক্ষার ভূমিকা এবং লক্ষ্য সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এটি শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন নয়, বরং তা সমাজের জনগণের ক্ষমতায়ন এবং মুক্তির পথ দেখায়। ফ্রেইরের তত্ত্ব সমাজে সাম্য, ন্যায় এবং সামাজিক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করতে পারে এবং শিক্ষাকে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। তার শিক্ষা দর্শন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সহায়তা করেছে, যা এখনো প্রভাব ফেলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *