পর্যটন মানবতত্ত্ব (Anthropology of Tourism) এমন একটি শাখা, যা পর্যটন শিল্পের প্রভাব, বিশেষ করে হোস্ট সম্প্রদায়ের সমাজ, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে তা বিশ্লেষণ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পর্যটন শিল্পের বিস্তার হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, যখন কোনো একটি সম্প্রদায় বা সংস্কৃতি পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, তখন তার উপর প্রভাব পড়তে পারে। এই প্রভাবগুলি শুধু অর্থনৈতিক বা পরিবেশগত নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক হতে পারে। এই নিবন্ধে, আমরা পর্যটনের হোস্ট সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব, তার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক, উদাহরণ এবং কেস স্টাডি বিশ্লেষণ করব।
পর্যটন মানবতত্ত্বের মূল ধারণা
পর্যটন মানবতত্ত্ব এমন একটি শাখা যা পর্যটনের প্রভাব এবং তার মাধ্যমে মানুষের আচরণ, জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং সমাজের মধ্যে আসা পরিবর্তনগুলির ওপর গবেষণা করে। এটি মনোযোগ দেয় কিভাবে বিভিন্ন সমাজ এবং সংস্কৃতি পর্যটকদের আগমন ও তাদের প্রভাবের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। গবেষণার মাধ্যমে, anthropologists পর্যটকদের প্রভাবের বিভিন্ন দিক যেমন—পরিবেশগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক বিশ্লেষণ করেন।
পর্যটন যে কোনও অঞ্চলের সংস্কৃতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারে। একটি স্থানের ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারা পর্যটকদের আগমনের মাধ্যমে কীভাবে পরিবর্তিত হয়, তা পর্যটন মানবতত্ত্ববিদদের গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই গবেষণার মাধ্যমে, তারা পর্যটনের ফলস্বরূপ উন্নয়ন এবং সংকটের মধ্যে সঠিক সমন্বয় প্রস্তাব করে।
হোস্ট সম্প্রদায়ে পর্যটনের ইতিবাচক প্রভাব
অন্য শহর বা দেশের পর্যটকরা যখন কোনো অঞ্চলে সফর করেন, তখন সাধারণত সেই অঞ্চলের অর্থনীতি এবং সমাজে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো:
১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন
পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হিসেবে কাজ করে। পর্যটকরা হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহন, স্থানীয় হস্তশিল্প এবং অন্যান্য পরিষেবার মাধ্যমে অর্থ ব্যয় করে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এই অর্থনৈতিক প্রবাহ স্থানীয় ব্যবসা এবং কর্মসংস্থানে সহায়ক হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, থাইল্যান্ডের পুকেট দ্বীপে পর্যটনের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বিভিন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। পর্যটকরা স্থানীয় হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং গাইড সার্ভিস থেকে উপকৃত হন, ফলে এখানকার অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হয়েছে। এটি স্থানীয় জনগণের আয়ের উৎস বৃদ্ধি করেছে এবং আরও অনেক মানুষের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করেছে।
২. সাংস্কৃতিক বিনিময়
পর্যটনের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে একধরনের সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে। স্থানীয় জনগণ এবং পর্যটকদের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায় এবং তারা একে অপরের সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য ও রীতিনীতি সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। এর ফলে, স্থানীয় জনগণ নিজেদের সংস্কৃতি আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে এবং বিশ্বের অন্যান্য সংস্কৃতির প্রতি তাদের মনোভাব আরও সমৃদ্ধ হয়।
হোস্ট সম্প্রদায়ে পর্যটনের নেতিবাচক প্রভাব
যদিও পর্যটন অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে উপকারী হতে পারে, তবুও এর নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। এই প্রভাবগুলির মধ্যে প্রধান কিছু হলো:
১. সাংস্কৃতিক হানি
পর্যটনের একটি প্রধান নেতিবাচক প্রভাব হলো সাংস্কৃতিক হানি বা ক্ষতি। যখন একটি সম্প্রদায় পর্যটকদের আকর্ষণীয় জায়গা হয়ে ওঠে, তখন তারা নিজেদের ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান, জীবনযাত্রা ও ভাষায় পরিবর্তন আনতে পারে। স্থানীয় সংস্কৃতি পর্যটকদের চাহিদার সাথে মানিয়ে চলে, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
একটি উদাহরণ হলো, ভারতে আগ্রা শহরে তাজমহলের চারপাশে পর্যটন ব্যবসা অনেক বেড়ে গেছে। অনেক সময়, স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি বজায় রাখতে না পেরে আধুনিক, বাণিজ্যিক মনোভাব গ্রহণ করেছে। এটি তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এক ধরনের সাংস্কৃতিক অভ্যস্ততা এবং আধুনিকায়নের সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
২. পরিবেশগত ক্ষতি
অতিরিক্ত পর্যটন শহর এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অত্যধিক পর্যটন জনবহুল এলাকাগুলিতে বর্জ্য সঞ্চয়, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং স্থানীয় বন্যপ্রাণীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মাচু পিচুর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পর্যটনের ফলে এই প্রাকৃতিক আশ্চর্যটির পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের আগমনে, পাথরের সিঁড়ি ও পাহাড়ের ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। পরিবেশগত চাপ এবং পাথরের ক্ষয়ের ফলে এই ঐতিহাসিক স্থানটির টেকসই ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।
৩. সামাজিক বৈষম্য ও আঞ্চলিক অস্থিরতা
পর্যটন স্থানীয় জনগণের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে, কারণ কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বেশি উপকৃত হয়, আবার অন্যরা বঞ্চিত হতে পারে। উন্নত শ্রেণীর পর্যটকরা সাধারণত স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারে, যা তাদের মধ্যে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
মিশরে লুক্সর শহরে পর্যটন বৃদ্ধির ফলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। ধনী পর্যটকদের জন্য নির্মিত বিলাসবহুল হোটেল এবং রিসোর্টগুলো স্থানীয় দরিদ্র জনগণের সঙ্গে সম্পর্ককে কঠিন করে তুলেছে। এখানে পর্যটন এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট।
কেস স্টাডি: বান্দুং, ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরটি পর্যটনের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি আকর্ষণীয় স্থান, বিশেষত প্রকৃতি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে। তবে, এখানে পর্যটনের নেতিবাচক প্রভাবও দেখা গেছে। শহরের স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে পর্যটকদের আগমন স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষতিকর পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
বান্দুং শহরের স্থানীয় জনগণ তাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে চাইলেও, পর্যটকদের প্রতি তাদের আচরণ এবং পর্যটন স্থানগুলিতে গিয়ে এক ধরনের ‘ভোগবাদী’ মনোভাব তৈরি হয়েছে। কিছু পর্যটক শহরের স্থানীয় বাজারে যাওয়ার পর, ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প এবং সাংস্কৃতিক সামগ্রী বিক্রির জন্য স্থানীয় জনগণকে চাপ দিয়েছেন। ফলে, শহরের সংস্কৃতির বিকৃতি ঘটেছে এবং স্থানীয় জীবনধারা পর্যটকদের চাহিদার সঙ্গে মানানসই হতে গিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে।
উপসংহার
পর্যটন মানবতত্ত্ব হোস্ট সম্প্রদায়ের উপর পর্যটনের প্রভাব সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে। পর্যটন একটি দ্বৈত প্রভাব সৃষ্টি করে—এটি যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় নিয়ে আসে, তেমনি এটি পরিবেশগত ক্ষতি, সামাজিক বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক হানির কারণও হতে পারে। তাই, পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি হোস্ট সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে, সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং টেকসই পর্যটনের দিকে মনোনিবেশ করা গুরুত্বপূর্ণ।