তাওবাদী দর্শনে “তাও” (Tao) শব্দটি মূলত চীনা ভাষার “পথ” বা “পথের সূচনা” অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাওবাদী দর্শন অনুযায়ী, তাও এমন একটি মৌলিক শক্তি বা প্রক্রিয়া, যা মহাবিশ্বের সব কিছু সৃষ্টি করে এবং এর মধ্যে সব কিছু চলে আসে। এটি কেবল একটি দার্শনিক ধারণা নয়, বরং একটি জীবনযাত্রার পথ যা প্রকৃতি, মানবজীবন, এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সঠিক সান্নিধ্য ও ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। তাই তাওকে “Way of Life” বা “জীবনের পথ” বলা হয়।
তাওকে “Way of Life” বলা হয়, কারণ এটি কেবল একটি দার্শনিক তত্ত্ব নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনযাত্রার দর্শন, যা প্রতিদিনের জীবনকে প্রাকৃতিক প্রবাহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে চালানোর উপদেশ দেয়। তাওবাদী দর্শনে “তাও” হল সেই পথ, যা অনুসরণ করলে একজন ব্যক্তি নিজেকে, সমাজকে, এবং প্রকৃতিকে একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়।
তাওকে “Way of Life” বলার কারণসমূহ:
1. প্রকৃতির সাথে মিল রেখে জীবন যাপন: তাওবাদী দর্শনে, তাও হল সেই অভ্যন্তরীণ শক্তি যা প্রকৃতির সব কিছু পরিচালনা করে। “Wu Wei” (অকর্মা কর্ম) তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের উচিত প্রাকৃতিক প্রবাহের বিরুদ্ধে না গিয়ে, তার সঙ্গে মিল রেখে জীবন যাপন করা। এর মানে হল, জীবনের প্রতিটি কাজ এমনভাবে করা উচিত যেন সেটি প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এখানে কোনো বিরোধ বা জোরজবরদস্তির প্রয়োজন নেই। প্রকৃতির মতো জীবনযাপন করতে পারলে তা একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনযাত্রার দিকে নিয়ে যায়।
উদাহরণ:
একজন তাওবাদী ব্যক্তি কৃষিকাজের সময় প্রকৃতির প্রাকৃতিক চক্র অনুযায়ী কাজ করে, অতিরিক্ত হারে কাজ না করে, তার বদলে সুষমভাবে কাজ করে।
2. অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে আত্মজ্ঞান: তাওবাদী দর্শন অনুযায়ী, প্রকৃত জীবন হল সেই জীবন যেখানে একজন ব্যক্তি নিজের অন্তরের সত্যকে বুঝতে পারে। তাও জীবন যাত্রায় আত্মজ্ঞান অর্জনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। তাও, বা জীবনপথের মাধ্যমে, একজন ব্যক্তি নিজের প্রকৃত সত্তাকে অনুভব করতে পারে এবং এর মাধ্যমে আধ্যাত্মিক শান্তি ও পরিপূর্ণতা লাভ করে।
উদাহরণ:
ধ্যান বা যোগচর্চা, যা তাওবাদীদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদের অন্তর্দৃষ্টি বাড়াতে সহায়তা করে। এটি তাদেরকে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শান্তির দিকে পরিচালিত করে।
3. অভ্যন্তরীণ শান্তি ও ভারসাম্য: তাওবাদী দর্শনে, জীবনের পথে চলতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ শান্তি ও ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “Yin-Yang” ধারণার মাধ্যমে এই ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। Yin এবং Yang হল বিপরীত শক্তি, যা একে অপরকে পরিপূরক এবং এই শক্তির সঠিক সমন্বয়ই জীবনের শান্তি এবং সুখের মূল।
উদাহরণ:
একজন তাওবাদী সাধক তার জীবনযাত্রায় সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। তিনি খুব বেশি কাজ (Yang) বা বিশ্রাম (Yin) এড়িয়ে চলেন, বরং একে অপরকে পরিপূরক করে একটি সঠিক জীবনধারা অনুসরণ করেন।
4. প্রকৃতির সাথে একাত্মতা: তাওবাদী দর্শনে প্রকৃতি ও জীবনের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। তাওবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, প্রকৃতির নিয়ম অনুসরণ করাই আসল জীবনযাপন। প্রকৃতি যা কিছু তৈরি করেছে, তা সবই তাওয়ের অংশ, এবং মানুষকেও সেই প্রকৃতির অংশ হিসেবে দেখতে হবে। প্রকৃতির মতো সহজ এবং সাদাসিধে জীবন যাপন করাই তাওয়ের অনুসরণ। এই পথে চলতে গেলে কোনো ধরনের সংগ্রাম বা বিরোধের প্রয়োজন নেই।
উদাহরণ:
একজন তাওবাদী ব্যক্তি প্রকৃতির রীতি অনুযায়ী কাজ করে, যেমন একটি গাছের শাখা-প্রশাখা থেকে শিক্ষা নিয়ে, যা সময়ের সাথে বৃদ্ধি পায় এবং ধীরে ধীরে স্থির হয়ে ওঠে, তেমনি সে তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ধৈর্য্য ধারণ করে।
5. অকর্মা কর্ম (Wu Wei): তাওবাদী দর্শনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হল Wu Wei, অর্থাৎ “অকর্মা কর্ম” বা “কর্মহীন কর্ম”। এর মানে হল, মানুষের উচিত কোনো কাজ করার সময় প্রচুর চেষ্টা বা চাপে না গিয়ে, প্রকৃতির মতো স্বাভাবিকভাবে এবং সহজভাবে কাজ করা। এই ধারণা প্রস্তাব করে যে, জীবনের পথ অনুসরণ করার ক্ষেত্রে মানুষের উচিত প্রাকৃতিক প্রবাহে বাধা না দেওয়া, বরং সেই প্রবাহের সঙ্গে একাত্ম হতে চাওয়া।
উদাহরণ:
একজন তাওবাদী মানুষ যদি নদীতে ঢেউ দেখে, তাহলে সে তা বাধা দিয়ে থামানোর চেষ্টা করবে না। বরং, সে ঢেউয়ের সঙ্গেই মেনে চলে, প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হতে দেয়। এটা তার জীবনে একটি গভীর শান্তি ও অস্থিরতা কমানোর পথ হিসেবে কাজ করে।
6. আধ্যাত্মিক মুক্তি ও অমরত্ব: তাওবাদী দর্শনে জীবনের আসল লক্ষ্য হল আধ্যাত্মিক মুক্তি বা অমরত্ব। যদিও তাওবাদীরা শারীরিক অমরত্ব বা চিরস্থায়ী জীবনকে গুরুত্ব দেয় না, তবে তারা আধ্যাত্মিক মুক্তির পথে চলতে চান। তাওয়ের অনুসরণ করে একজন ব্যক্তি তার আত্মাকে শুদ্ধ করতে পারে এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারে, যা আধ্যাত্মিক মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।
উদাহরণ:
তাওবাদী সাধকরা ধ্যান, যোগ এবং প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার মাধ্যমে তাদের আত্মাকে শুদ্ধ ও মুক্ত করার চেষ্টা করেন। এর মাধ্যমে তারা প্রকৃতির গভীর রহস্য বোঝার সক্ষমতা অর্জন করেন।
7. সমাজে শান্তি এবং সহযোগিতা: তাওবাদী দর্শনে, সমাজের শান্তি এবং সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যক্তি যখন প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন, তখন সে সমাজে শান্তি এবং সহযোগিতার দিকে এগিয়ে যেতে পারেন। তাওবাদী বিশ্বাস করে যে, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে শান্তি এবং মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা থাকা প্রয়োজন। তাওয়ের অনুসরণ করে একজন ব্যক্তি সমাজে সদ্ব্যবহার এবং আন্তরিকতার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
উদাহরণ:
তাওবাদী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা ব্যাপকভাবে দেখা যায়, যেখানে সদস্যরা একে অপরকে সমর্থন দিয়ে, শান্তিপূর্ণভাবে একত্রে জীবন যাপন করেন।
উপসংহার:
তাওকে “Way of Life” বলা হয়, কারণ এটি কেবল একটি দার্শনিক তত্ত্ব নয়, বরং এটি জীবনযাত্রার একটি পূর্ণাঙ্গ পথ। এই পথ অনুসরণ করে একজন ব্যক্তি প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে জীবনযাপন করতে পারে, আধ্যাত্মিক মুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে পারে, এবং মানসিক ও শারীরিক শান্তি লাভ করতে পারে। তাও জীবনের সকল স্তরের মধ্যে শান্তি, সমতা, এবং ভারসাম্য আনতে সহায়ক, এবং এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি কর্মে এবং মনোভাবের মধ্যে সঠিক নির্দেশনা প্রদান করে।