জার্নালিজম নৈতিকতা: অবজেকটিভিটি এবং অ্যাডভোকেসির মধ্যে ভারসাম্য

জার্নালিজম বা সাংবাদিকতা, যে কোনো সমাজের হৃদয়ে বসে থাকে, সেটি মানুষের তথ্যের চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য করে, জনগণকে সচেতন করে তোলে এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে। সাংবাদিকতা তখনই সফল, যখন এটি সঠিক তথ্য উপস্থাপন করতে পারে, এবং জনগণকে প্রভাবিত করার জন্য পক্ষপাতিত্ব না করে একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার বিশ্লেষণ করে। তবে সাংবাদিকতার কাজ শুধু তথ্য প্রদান নয়, কখনও কখনও এটি সমাজের বিভিন্ন ইস্যুতে নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে সহায়ক হয়, এবং এজন্য সাংবাদিকদের মাঝে থাকা নৈতিকতার ধারনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নৈতিকতা অবশ্যই অভ্যন্তরীণ মতামত এবং প্রভাবের বাইরে থেকে জনগণের জন্য সঠিক দৃষ্টিকোণ তুলে ধরতে সাহায্য করে। কিন্তু সাংবাদিকতার নৈতিকতা শুধুমাত্র নিরপেক্ষতা বজায় রাখা বা একদিকে না ঝুঁকে থাকা নয়, এটি কখনও কখনও সামাজিক পরিবর্তন সাধনেও সহায়ক হতে পারে। এটি বোঝার জন্য “অবজেকটিভিটি” এবং “অ্যাডভোকেসি”—এই দুটি মূল ধারণা খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

অবজেকটিভিটি (Objective) এবং অ্যাডভোকেসি (Advocacy)—এই দুটি শব্দ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। “অবজেকটিভিটি” অর্থ একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনা তুলে ধরা, যেখানে সাংবাদিক নিজে কোনো পক্ষ বা গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখান না। সাংবাদিকতা থেকে আশা করা হয় যে, তারা যেমন বাস্তবতা প্রতিবেদন করবে, তেমনি জনগণের কাছে সঠিক ও প্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহ করবে। তবে, কখনও কখনও সাংবাদিকদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক দায়িত্বের প্রতি জবাবদিহিতা থেকে “অ্যাডভোকেসি” বা পক্ষ নেওয়া এক বিশেষ ভূমিকা নেয়। অর্থাৎ, কোনো সামাজিক বা নৈতিক কারণে সাংবাদিকরা নিজেদের দৃষ্টিকোণ স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারেন, তবে এতে যাতে সাংবাদিকের পেশাদারিত্ব ক্ষুন্ন না হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি।

অবজেকটিভিটি এবং অ্যাডভোকেসির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা: সাংবাদিকদের প্রধান কাজ হলো ন্যায়সঙ্গত, নিরপেক্ষ এবং সতর্কভাবে ঘটনা তুলে ধরা, কিন্তু কখনও কখনও কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার প্রতি প্রতিবাদ বা নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই অবস্থানটি থাকতে পারে সরকারের বিরুদ্ধে, সমাজের কোনো স্তরের বিরুদ্ধে বা পরিবেশগত বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে। তবে, যখন সাংবাদিকরা কোনো ঘটনা বা বিষয়ে পক্ষ নেন, তখন তাদের মেধা ও দক্ষতা অবশ্যই ন্যায্য, সঠিক এবং প্রমাণিত হওয়া উচিত। অতএব, সাংবাদিকের কাজ শুধুমাত্র ঘটনা রিপোর্ট করা নয়, বরং জনগণের জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করা।

তবে, কিছু সাংবাদিক তাঁদের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করে ফেলেন, যা অবজেকটিভিটির পরিপন্থী হতে পারে। যেমন, ২০১৬ সালে “ব্রেক্সিট” ভোটের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে বা বিপক্ষে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম তাদের দৃষ্টিকোণ প্রকাশ করেছিল। কিছু মিডিয়া আউটলেট এর বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছে, যখন কিছু মিডিয়া তাদের সমর্থন দিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা একদিকে যদি অবজেকটিভিটি বজায় রাখে, তবে অন্যদিকে তারা অবশ্যই জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য অ্যাডভোকেসি করতে পারে।

একটি কেস স্টাডি: ২০০৭ সালের “এনরন স্ক্যান্ডাল” এটি ছিল একটি বিশাল আর্থিক কেলেঙ্কারি, যা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ এনার্জি কোম্পানি “এনরন” এর দ্বারা সংঘটিত হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং মিডিয়া আউটলেটস এই কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ করেছিল, এবং তাদের রিপোর্টে অবজেকটিভিটির পাশাপাশি নৈতিক দায়িত্বও ছিল। এখানে সাংবাদিকরা শুধু ঘটনার তথ্য প্রদান করেননি, বরং তারা কোম্পানির দুর্নীতি এবং জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনের অভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। এই ধরনের অ্যাডভোকেসি শুধু সংবাদ প্রতিবেদন নয়, বরং সাধারণ জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং পরবর্তী সময়ে এনরনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়।

অবজেকটিভিটি বনাম অ্যাডভোকেসি—কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ?: যখন সাংবাদিকতার কথা আসে, তখন একে একে অবজেকটিভিটি এবং অ্যাডভোকেসির গুরুত্বের কথা বলা যায়। তবে, অবজেকটিভিটির পক্ষকারীরা বলে থাকেন, যে কোনো সাংবাদিকের আগে “নিরপেক্ষ” থাকার দায়িত্ব থাকে, এবং কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করলে তার পেশাগত বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়। অন্যদিকে, অ্যাডভোকেসির পক্ষে যারা কথা বলেন, তাদের মতে, সাংবাদিকদের কখনও কখনও তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করা উচিত, এবং যদি কোনো বিষয় সামাজিক ন্যায় বা মানবাধিকার সম্পর্কিত হয়, তবে সাংবাদিকদের সঠিক দৃষ্টিকোণ এবং নিরপেক্ষতা ছাড়াই প্রতিবাদ করা উচিত।

তবে, এটি স্পষ্ট যে, সাংবাদিকদের কাজ শুধুমাত্র তথ্য প্রদান করা নয়, বরং তাদের অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত যে কীভাবে তারা ঘটনাকে দেখেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে “গ্লোবাল ওয়ার্মিং” বা “পরিবেশগত বিপদ” নিয়ে সাংবাদিকদের কর্মকাণ্ড বিবেচনা করা যেতে পারে। পৃথিবীজুড়ে এই বিষয়টিকে কিছু সাংবাদিকরা অবজেকটিভ পদ্ধতিতে তুলে ধরেছেন, যেখানে শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য দেয়া হয়েছে। তবে, একই সময়ে কিছু মিডিয়া হাউস এই বিষয়টি সম্পর্কে অ্যাডভোকেসি করেছে, জনগণকে সচেতন করার জন্য এ বিষয়ে প্রতিবাদ এবং পরিবর্তন আনার জন্য পদক্ষেপ নিতে উত্সাহিত করেছে।

উপসংহার: অবজেকটিভিটি এবং অ্যাডভোকেসি উভয়ই সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সাংবাদিকদের অবশ্যই তাদের পেশাগত নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে। তারা যদি অবজেকটিভ থাকতে চান, তবে তাদের রিপোর্টটি সঠিক, নিরপেক্ষ এবং প্রমাণিত হওয়া উচিত, এবং যদি তারা অ্যাডভোকেসি করেন, তবে তা যেন সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হয়। একজন সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র তথ্য প্রদান নয়, বরং সমাজে সঠিক বার্তা পৌঁছে দেয়া, যা জনগণের কল্যাণে কাজ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *