জন ডিউই ছিলেন একজন প্রভাবশালী শিক্ষাবিদ এবং দার্শনিক, যিনি শিক্ষার উপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন। তিনি শিক্ষাকে জীবনের একটি অংশ হিসেবে দেখেছেন এবং সমাজে শিক্ষার ভূমিকা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন। তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাদর্শন এবং সেগুলোর বাংলা ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলোঃ
1. শিক্ষা একটি সামাজিক শক্তি; শিক্ষা হলো বৃদ্ধি; শিক্ষা জীবনের প্রস্তুতি নয় বরং জীবন নিজেই
ডিউই মনে করেন, শিক্ষা কেবল জ্ঞানের ভাণ্ডার বাড়ানোর জন্য নয়, বরং এটি মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত বিকাশে সহায়ক। শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা শিক্ষার্থীকে বর্তমান ও ভবিষ্যতে জীবন পরিচালনা করতে সাহায্য করে।
2. শিক্ষা জীবনের প্রস্তুতি নয়; শিক্ষা নিজেই জীবন
ডিউইর মতে, শিক্ষা এমন কিছু নয় যা ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে রাখা হয়। বরং, এটি জীবনের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। তিনি বিশ্বাস করেন যে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের বর্তমান বাস্তবতা এবং পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা প্রদান করা।
3. আমরা অভিজ্ঞতা থেকে শিখি না, বরং অভিজ্ঞতার ওপর প্রতিফলনের মাধ্যমে শিখি
ডিউই মনে করেন, অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অনেক, তবে তা থেকে শিখতে হলে শিক্ষার্থীদের নিজেদের অভিজ্ঞতার ওপর চিন্তা বা প্রতিফলন করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যখন তাদের অভিজ্ঞতার বিষয়ে চিন্তা করে, তখন তারা নতুন জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
4. শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়া নয়; শিক্ষা শিক্ষার্থীর সক্রিয় কার্যকলাপের ফল
ডিউইর মতে, শিক্ষার্থীর নিজের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমেই প্রকৃত শিক্ষা অর্জিত হয়। অন্যের শিখিয়ে দেওয়া তথ্য নয়, বরং শিক্ষার্থীর নিজের অনুসন্ধান ও কর্মকাণ্ড থেকেই প্রকৃত জ্ঞান আসে।
অভিজ্ঞতার দুটি প্রকার:
ডিউই অভিজ্ঞতাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন—
বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা: এটি বাস্তব জীবনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা, যা দৈনন্দিন জীবনে ঘটে।
অর্থবহ অভিজ্ঞতা: শিক্ষার্থীর জন্য যা আরও গভীর অর্থ বহন করে, যা তাদের চিন্তাশক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা বিকাশে সহায়ক হয়।
অনুসন্ধান (Enquiry)
ডিউইর মতে, অনুসন্ধান হল শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তৈরি করে, অনুমান (hypothesis) করে, পরীক্ষা চালায় এবং নতুন তত্ত্ব বা ধারণা তৈরি করে। এটি তাদের জ্ঞান আহরণ এবং উন্নত বিশ্লেষণী দক্ষতা অর্জনের পথ দেখায়।
গণতন্ত্র ও সামাজিক সংস্কার
ডিউই বিশ্বাস করেন, শিক্ষার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ধারণা এবং সামাজিক সংস্কার সম্ভব। স্কুলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে সমাজে সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ করতে পারে।
সামাজিক মূল্যবোধ এবং বৈষম্য বিরোধিতা
ডিউইর দৃষ্টিতে শিক্ষা সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে সহায়ক এবং এটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে বৈষম্য দূর করতে ভূমিকা পালন করতে পারে।
সীমাবদ্ধতা
ডিউইর শিক্ষাদর্শনের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন, তার শিক্ষা পদ্ধতি বড় শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করা বেশ কঠিন এবং এটি সময়সাপেক্ষ হতে পারে। এছাড়া সব শিক্ষার্থী একই হারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে না, যা শিক্ষাদানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
ডিউইর এই ধারণাগুলি আধুনিক শিক্ষাদর্শন এবং শিক্ষানীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। তার এই শিক্ষাভাবনা এখনও শিক্ষাবিদদের মধ্যে নতুন চিন্তার সূচনা ঘটাতে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।