জন ডিউই (John Dewey) ছিলেন একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত দার্শনিক, শিক্ষা চিন্তাবিদ এবং মনস্তত্ত্ববিদ। তিনি আধুনিক শিক্ষাবিদ্যায় এক অনন্য স্থান অধিকার করেছেন এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার কাঠামো ও পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ডিউইয়ের মতে, শিক্ষা শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন নয়, বরং এটি জীবন জীবনের এক অংশ, যেখানে শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে তাদের পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তা থেকে শিক্ষা লাভ করে।
ডিউইয়ের শিক্ষাদর্শন মূলত তার ‘প্রাকৃতিক শিক্ষাবাদ’ বা ‘এক্সপেরিমেন্টালিজম’ এর ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তার মতে, শিক্ষা হলো একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যা অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ঘটতে থাকে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের সামাজিক জীবনের জন্য প্রস্তুত করা, যাতে তারা নিজেদের চিন্তাভাবনা ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে একটি উন্নত সমাজ গঠন করতে পারে।
জন ডিউইয়ের শিক্ষাদর্শনের মূল বৈশিষ্ট্য
1. শিক্ষা জীবনের অংশ: জন ডিউইয়ের মতে, শিক্ষা জীবন ও সমাজের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষার্থীরা কেবল পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার জন্য প্রয়োজন। তাঁর ধারণা অনুসারে, শিক্ষার কার্যকলাপ জীবনের প্রস্তুতি হওয়া উচিত, যা তাদের পরবর্তী জীবনে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা তৈরি করবে।
2. কেন্দ্রবিন্দু শিক্ষার্থী: ডিউইয়ের শিক্ষাদর্শনে শিক্ষার্থীই শিক্ষার কেন্দ্রে। শিক্ষক কেবল গাইড বা সহায়ক হিসেবে কাজ করে। শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তা, প্রশ্ন এবং অন্বেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করে। এভাবে তারা সৃজনশীলতা এবং চিন্তা শক্তি বিকাশ করে।
3. অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখানো: জন ডিউইয়ের মতে, শিক্ষা কেবল তথ্য প্রদান নয়, বরং এটি একটি প্রক্রিয়া, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখে। এটি ‘প্রাকৃতিক শিক্ষা’ বা ‘এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিং’ এর ধারণার ওপর ভিত্তি করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে শিখে।
4. সমাজ ও সম্প্রদায়ের ভূমিকা: ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনের একটি বড় অংশ হলো সমাজের সাথে শিক্ষার সম্পর্ক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষা কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করে। সমাজের সদস্য হিসেবে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং সুশীল নাগরিকত্বের শিক্ষা দেওয়া উচিত।
ডিউইয়ের শিক্ষার লক্ষ্য
জন ডিউইয়ের শিক্ষাদর্শনের মূল লক্ষ্যগুলির মধ্যে শিক্ষা ও শেখার প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। তার শিক্ষার লক্ষ্যগুলির মধ্যে প্রধান লক্ষ্য নিম্নরূপ:
1. সৃজনশীল চিন্তা ও সমাধান ক্ষমতা: শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে শিখানো এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খোঁজার জন্য তাদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন ক্ষমতা বিকাশ করা।
2. জীবনের জন্য প্রস্তুতি: শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত করা, যাতে তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
3. স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাস: শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী এবং স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে শেখানো। তাদের নিজেদের মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা দেওয়া।
4. সমাজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন: শিক্ষার্থীদের সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে শেখানো, যাতে তারা সমাজের সদস্য হিসেবে তাদের দায়িত্ব বুঝতে পারে।
5. সমবায় চিন্তাভাবনা: শিক্ষার্থীদের একে অপরের সঙ্গে কাজ করতে শেখানো, যাতে তারা সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে তোলে এবং সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে।
6. সামাজিক দায়িত্ববোধ: শিক্ষার্থীদের সামাজিক নৈতিকতা, দায়িত্ব এবং ন্যায়বিচারের প্রতি সচেতন করা, যাতে তারা ভাল নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।
7. জ্ঞান অর্জনের সঙ্গীতমূলক উপায়: শিক্ষার জন্য যান্ত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের আবেগ ও অনুভূতির মাধ্যমে শেখানোর প্রচেষ্টা করা। এতে তারা জ্ঞান অর্জনের প্রতি আগ্রহী হয়।
8. স্বতন্ত্র চিন্তা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা: শিক্ষার্থীদের নিজের চিন্তাভাবনা তৈরি করতে উৎসাহিত করা এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা।
9. জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া বোঝানো: শিক্ষার্থীদের শেখানোর প্রক্রিয়ায় কীভাবে তারা শিখছে এবং কেন শিখছে তা বোঝানো, যাতে তারা নিজের শিক্ষার প্রতি সচেতন হয়।
10. অনুশীলনমূলক শিক্ষা: শিক্ষার্থীদের কেবল তাত্ত্বিক নয়, বরং বাস্তবিক বা অনুশীলনমূলক জ্ঞান দেওয়া, যাতে তারা জীবনের প্রকৃত সমস্যায় প্রয়োগ করতে পারে।
11. খোলামেলা আলোচনা: শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্ত আলোচনা এবং বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি করা, যাতে তারা নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করতে শেখে।
12. দক্ষতা ও কৌশলের উন্নয়ন: শিক্ষার্থীদের বিশেষ দক্ষতা এবং কৌশল শেখানোর মাধ্যমে তাদের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।
13. প্রকৃতির প্রতি সচেতনতা: প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তৈরি করা, যাতে শিক্ষার্থীরা পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারে।
14. স্বীকৃতির প্রতি দৃষ্টি: শিক্ষার্থীদের তাদের কর্মের ফলস্বরূপ স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে তারা আরও ভালোভাবে শেখার জন্য অনুপ্রাণিত হয়।
15. দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জন: শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র বর্তমানে না, বরং ভবিষ্যতের জন্যও পরিকল্পনা এবং লক্ষ্য স্থির করার ক্ষমতা তৈরি করা।
জন ডিউই (John Dewey) ২০শ শতকের প্রখ্যাত মার্কিন দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদ ছিলেন, যিনি শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে অভিজ্ঞতা এবং কার্যক্রমের গুরুত্বের প্রতি জোর দিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষা দর্শনের মূলনীতি গুলো হলো:
১. অভিজ্ঞতার গুরুত্ব:
ডিউইয়ের মতে, শিক্ষা কেবল তথ্য শেখার বিষয় নয়, বরং এটি একটি ক্রমবর্ধমান অভিজ্ঞতা। শিক্ষার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখে এবং বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলি সমাধান করতে শিখে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে নতুন কিছু তৈরি এবং পরীক্ষা করতে পারে।
২. প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা (Project-Based Learning):
ডিউই প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষার সমর্থক ছিলেন। তাঁর মতে, শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা পায় যখন তারা বাস্তব কাজের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে কাজ করে, যা তাদের চিন্তাভাবনা, বিশ্লেষণ এবং সৃজনশীলতা বাড়ায়।
৩. শিক্ষকের ভূমিকা:
ডিউইয়ের মতে, শিক্ষকের কাজ শুধুমাত্র তথ্য সরবরাহ করা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা। শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সাথে সহযোগিতা করে তাদের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিকে উৎসাহিত করতে হয়।
৪. সমস্যা ভিত্তিক শিক্ষা (Problem-Based Learning):
ডিউই বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষার্থীদেরকে চিন্তার প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করানোর জন্য তাদের সামনে সমস্যার সম্মুখীন করতে হবে। সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা নতুন ধারণা ও দক্ষতা অর্জন করে, যা তাদের ভবিষ্যতের জীবনে সহায়ক হয়।
৫. সামাজিক এবং গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ:
ডিউই শিক্ষাকে সামাজিক এবং গণতান্ত্রিক জীবনযাত্রার জন্য অপরিহার্য হিসেবে দেখতেন। তাঁর মতে, শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমাজসেবা, সহযোগিতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলে।
৬. শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য:
ডিউইয়ের মতে, শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের জীবনের জন্য প্রস্তুত করা। এটি তাঁদের শুধু তথ্য শেখানোর মাধ্যম নয়, বরং একটি সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি, যাতে তারা জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শন বর্তমান সময়ে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তা হিসাবে বিবেচিত হয়, যেখানে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সমালোচনা:
1. অতিরিক্ত প্রাকৃতিকীকরণ:
কিছু সমালোচক বলেছেন, ডিউইয়ের শিক্ষাদর্শন জীবনের প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয় এবং ঐতিহ্যগত শিক্ষা ও কঠিন শৃঙ্খলা থেকে দূরে সরে যায়। ফলে তা কিছুক্ষেত্রে শিশুদের অভ্যন্তরীণ নিয়ম-কানুন শেখার প্রয়োজনীয়তা হারাতে পারে।
2. রূঢ় বাস্তবতা উপেক্ষা:
ডিউইয়ের শিক্ষাদর্শন প্রকৃতির সাথে সংযুক্ত, তবে কিছু সমালোচক মনে করেন যে, তার তত্ত্বগুলি সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার জটিলতাকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে না। অর্থাৎ, এটি কখনও কখনও কার্যকরী সমাজ-রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে অপর্যাপ্ত হতে পারে।
3. দর্শন ও বাস্তবতার মাঝে ফাঁক:
অনেকেই বলছেন যে, ডিউইয়ের দর্শন বাস্তব শিক্ষার প্রয়োগে সবসময় কার্যকরী হয় না। তার শিক্ষাব্যবস্থা কখনো কখনো শিক্ষকদের জন্য কঠিন হয়ে যায়, যেহেতু তারা প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাকে এক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দিতে চান। এটি শিক্ষকের ওপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
4. পরিসর বা কাঠামোর অভাব:
ডিউইয়ের শিক্ষাদর্শন অনেকটা শিশুর স্বাধীনতা ও স্বাধীন চিন্তাধারাকে প্রাধান্য দেয়। তবে এর ফলে শ্রেণীকক্ষে কাঠামোর অভাব হতে পারে, যা কিছু শিক্ষার্থীর জন্য বিভ্রান্তিকর বা অপ্রয়োজনীয় হতে পারে।
5. মনোবৈজ্ঞানিক সীমাবদ্ধতা:
শিক্ষার প্রাকৃতিক প্রবাহের ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হলেও, কিছু মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, ডিউইয়ের ধারণা গুলি সব শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। বিশেষ করে, যারা নির্দিষ্ট কাঠামোর মাধ্যমে শিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তাদের জন্য এই পদ্ধতি উপযোগী নাও হতে পারে।
উপসংহার
জন ডিউইয়ের শিক্ষাদর্শন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম মূল ভিত্তি। তার দর্শন অনুযায়ী, শিক্ষা জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা কেবল তথ্য প্রদান নয়, বরং শিক্ষার্থীদের চিন্তা, সমাজ, নৈতিকতা, ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে উন্নতি সাধন করে। ডিউইয়ের শিক্ষার ১৫টি লক্ষ্য মূলত তার এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব চিন্তা, দক্ষতা, এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের মাধ্যমে একটি উন্নত সমাজ গঠনের জন্য প্রস্তুত হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কেবল তথ্য গ্রহণকারী নয়, বরং চিন্তাশীল, সৃজনশীল এবং সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে পরিণত হয়।