জন ডিউই (John Dewey) আধুনিক শিক্ষা দর্শনের অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তাবিদদের মধ্যে একজন। তার শিক্ষা দর্শন প্রগতিশীল শিক্ষা আন্দোলনের মূল ভিত্তি এবং তার চিন্তাধারা বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ডিউইয়ের দর্শন মূলত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিক্ষাকে মূল্যায়ন করে এবং শেখার প্রক্রিয়াকে একটি সক্রিয়, সামাজিক ও জীবনমুখী প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু তার এই দর্শনে কোন কোন দার্শনিকদের প্রভাব রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা দেখতে পাই যে, ডিউইয়ের দর্শনে বিভিন্ন দার্শনিকের চিন্তা ও তত্ত্বের সমন্বয় রয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকদের প্রভাব এবং কিভাবে তাদের তত্ত্ব ডিউইয়ের চিন্তাধারায় প্রতিফলিত হয়েছে।
১.অ্যারিস্টটলের
অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারা ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনে প্রভাব ফেলেছে। অ্যারিস্টটল শিক্ষা এবং জ্ঞান অর্জনের বিষয়ে তার দর্শনে ‘এথিক্স’ এবং ‘নিউমেনিকা’ গ্রন্থে কিছু মৌলিক ধারণা প্রদান করেছেন। অ্যারিস্টটল মতে, মানুষের প্রকৃত লক্ষ্য হলো সুখী জীবন এবং সঠিক আচরণ, যা অর্জন করা যায় চিন্তার মাধ্যমে। তিনি ‘এথিক্স’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ব্যক্তি তার জীবনকে পুরোপুরি বিকশিত করতে সক্ষম হবে তখনই, যখন তার আচরণ ও চিন্তাভাবনা যথাযথ হবে।
ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনেও শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও বিচারশক্তির বিকাশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার মতে, শিক্ষা কেবলমাত্র তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং এটি চিন্তা ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া। অ্যারিস্টটলের ‘এথিক্স’-এর মতে, শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আত্ম-উন্নয়ন এবং একটি পরিপূর্ণ জীবন অর্জন, যা তাদের চিন্তাভাবনা এবং আচরণের মাধ্যমে সম্ভব।
ডিউইয়ের শিক্ষায় “প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষা” এবং “চিন্তার বিকাশের মাধ্যমে সঠিক আচরণের শিক্ষা” এই দুইটি অ্যারিস্টটলের তত্ত্বের প্রতিফলন। ডিউই বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষার্থীরা নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখে এবং তাদের চিন্তার মাধ্যমে আত্ম-উন্নয়ন ঘটায়।
২. জেমস ড্যুয়ান (William James)
জেমস ড্যুয়ান ছিলেন একজন মার্কিন দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী, যিনি অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন ও দর্শনের ‘প্রাগমেটিজম’ তত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা। তার ‘প্রাগমেটিজম’ তত্ত্ব ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। জেমসের মতে, অভিজ্ঞতা সবকিছুর ভিত্তি এবং কোনো তত্ত্ব বা ধারণার মূল্য তার ব্যবহারিক ফলাফলেই নিহিত থাকে।
ডিউইয়ের শিক্ষাদর্শনের অন্যতম মৌলিক দিক হলো তার অভিজ্ঞতাবাদী মনোভাব। তার মতে, শেখার প্রক্রিয়াটি হল এক ধরনের ‘অভিজ্ঞতার প্রক্রিয়া’, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজেদের জ্ঞান বাড়ায়। শিক্ষাকে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে শিখতে পারে। তার মতে, শিক্ষা একটি একেবারে জীবন্ত প্রক্রিয়া, যেখানে শিশুরা ক্রমাগত পরীক্ষা করে এবং তাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখে যায়।
জেমসের ‘প্রাগমেটিজম’ তত্ত্বে প্রতিফলিত হচ্ছে ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনের সেই দিকটি যেখানে তিনি শিক্ষা প্রক্রিয়াকে একটি জীবন্ত, পরীক্ষামূলক এবং সক্রিয় প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেন, যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয় এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলে।
৩. চার্লস সান্ডার্স পার্স (Charles Sanders Peirce)
পার্স ছিলেন একজন যুক্তিবিদ এবং সেমিওটিক্সের (চিহ্ন তত্ত্ব) পিতৃপুরুষ। তার চিন্তাধারা ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। পার্সের মতে, চিন্তা বা যুক্তি একটি প্রক্রিয়া, যা পরীক্ষামূলক এবং পর্যবেক্ষণমূলক। তাঁর এই তত্ত্বে ডিউইয়ের শিক্ষার সাথে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে, কারণ ডিউইও মনে করতেন যে, শিক্ষা একটি ক্রমাগত প্রশ্ন এবং পরীক্ষার প্রক্রিয়া।
ডিউইয়ের চিন্তাভাবনা অনুসারে, শিক্ষার্থীদের জন্য ‘প্রশ্ন করা’ এবং ‘সমাধান খোঁজা’ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় এবং এই প্রক্রিয়াটি তাদের চিন্তার দক্ষতা ও যুক্তিবিজ্ঞানের বিকাশে সহায়তা করে। এই ধারণা পার্সের ‘লজিক অব সাইন’ (Logic of Signs) এবং ‘ডেভেলপমেন্ট অব আইডিয়াস’ তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
পার্সের তত্ত্ব অনুযায়ী, চিন্তা সব সময় একটি অনুসন্ধান এবং পরীক্ষার প্রক্রিয়া, যা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত থাকে। ডিউইও একইভাবে বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজেদের চিন্তা এবং জ্ঞান গঠন করে।
৪. জোহান ফ্রিডরিচ হেগেল (Georg Wilhelm Friedrich Hegel)
হেগেলের দার্শনিক চিন্তাধারা, বিশেষ করে তার ‘থিসিস-অ্যান্টিথিসিস-সিনথিসিস’ ধারণা, ডিউইয়ের চিন্তাভাবনার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। হেগেল মনে করতেন, যে কোনো চিন্তা বা ধারণা তার বিপরীত ধারণার মাধ্যমে বিকশিত হয় এবং এই বিরোধের মাধ্যমে একটি নতুন সমাধান (সিনথিসিস) জন্ম নেয়।
ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনেও এই তত্ত্বের প্রভাব দেখা যায়। ডিউইয়ের মতে, শেখার প্রক্রিয়া একটি গঠনমূলক প্রক্রিয়া, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তাভাবনাকে পরিপূর্ণ করতে নতুন ধারণা গ্রহণ করে এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিখে যায়। শিক্ষার্থীরা থিসিস ও অ্যান্টিথিসিসের মাধ্যমে তাদের চিন্তাকে পরীক্ষা করে এবং নতুন সমাধান বের করে। এই ভাবনাটি হেগেলের চিন্তাধারার সঙ্গে মেলে, যেখানে চিন্তা এবং যুক্তির বিকাশ ঘটতে থাকে।
ডিউইয়ের শিক্ষার মূল দিক হলো শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিকাশ, যেখানে তারা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করে এবং এর মাধ্যমে একটি সম্যক জ্ঞান অর্জন করে।
৫. জোহান জ্যাক রুসো (Jean-Jacques Rousseau)
জ্যাক রুসো, একজন ফরাসি দার্শনিক, তার ‘এমিল’ (Emile) গ্রন্থে শিক্ষার বিষয়ে কিছু মৌলিক চিন্তা পেশ করেন। রুসো বিশ্বাস করতেন, শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রকৃতির সঙ্গে সান্নিধ্য অপরিহার্য। তিনি মনে করতেন যে, শিশুরা তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখতে পারে এবং এই প্রক্রিয়া তাদের বিকাশের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী।
ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনেও রুসোর এই ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে। ডিউইয়ের মতে, শিশুর অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষাকে শিশুর প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে। তিনি মনে করতেন যে, শিক্ষা শিশুর স্বাভাবিক কৌতূহল এবং আগ্রহের ভিত্তিতে হওয়া উচিত, যাতে তারা নিজেদের পরিবেশের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে শিখতে পারে। রুসোর ‘প্রাকৃতিক শিক্ষা’ ধারণা ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে, যেখানে শিশুর পরিবেশ এবং অভিজ্ঞতা তাদের শেখার মূল ভিত্তি।
উপসংহার
ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শন বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তাভাবনার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। অ্যারিস্টটল, জেমস ড্যুয়ান, পার্স, হেগেল, এবং রুসো—এইসব দার্শনিকের তত্ত্ব ডিউইয়ের চিন্তাধারায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। তারা সবাই শিক্ষা এবং চিন্তা, অভিজ্ঞতা এবং পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ডিউইয়ের শিক্ষা দর্শনে এই সকল তত্ত্বের সংমিশ্রণ তাকে আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানী হিসেবে তুলে ধরেছে। তার দর্শন শিক্ষাকে একটি সক্রিয়, জীবন্ত, এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার প্রক্রিয়া হিসেবে মূল্যায়ন করে, যা এখনো বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।