চার্বাক দর্শন

চার্বাক দর্শন (বা লৌকিক দর্শন) হলো প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের একটি শক্তিশালী ন্যাচারালিস্টিক বা যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দর্শন। এটি এক ধরনের materialistic দর্শন, যেখানে ঈশ্বর বা পরকালীন জীবন, পুনর্জন্ম, কৃতকর্মের ফল ইত্যাদি ধারণা অস্বীকার করা হয়েছে। চার্বাক দর্শনের মূল বিষয় হল যে, পৃথিবী এবং সমস্ত বস্তুগত জগতই একমাত্র প্রকৃত বাস্তবতা, এবং সমস্ত কিছু উপভোগ করা উচিত। এই দর্শনে বিশ্বাসীরা জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল সুখী ও আনন্দময়ভাবে জীবনযাপন করা, কারণ তারা মনে করেন, মৃত্যুর পর আর কিছুই নেই।চার্বাক দর্শন বিশেষভাবে ‘অথৈবাদ’ বা ‘অস্তিত্ববাদ’ দ্বারা চিহ্নিত। তাদের মতে, মানবজীবনের সকল অভিজ্ঞতা জড় ও যৌগিক উপাদান থেকে উদ্ভূত। তারা বিশ্বাস করতেন, সত্য কেবলমাত্র দেখা এবং পরীক্ষার মাধ্যমে জানা সম্ভব। ধর্মীয় আচার, পুরাণ এবং অশাস্ত্রীয় বিশ্বাসকে তারা অসার ও ভুল বলেছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন, মানুষের জীবনে যা কিছু ভাল, তা কেবলমাত্র তার অনুভূতি, চিন্তা এবং বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত।

চার্বাক দর্শন প্রাচীন ভারতের অন্যান্য দর্শনের সাথে মৌলিকভাবে ভিন্ন ছিল, কারণ এটি অতীন্দ্রিয় বা ঐশ্বরিক ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং অভিজ্ঞতামূলক দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করেছিল।

চার্বাক দর্শনকে লোকায়ত দর্শন বলা হয়:

চার্বাক দর্শনকে “লোকায়তদর্শন” বলা হয় তার কারণ হলো এই দর্শনটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন, অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। “লোকায়ত” শব্দটি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত, যেখানে “লোক” মানে পৃথিবী বা সাধারণ জীবন, এবং “আয়ত” মানে আত্মা বা দর্শন। এই দর্শনটির মূল বক্তব্য হলো পৃথিবীর মধ্যে বসবাসকারী মানুষেরই সবচেয়ে বড় প্রমাণিত সত্য। চার্বাক দর্শন কোন ধরণের আধ্যাত্মিক বা পরকালীন বিশ্বাসকে মেনে নেয় না। এটি কেবলমাত্র অনুভূতি, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান এবং সরাসরি বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল। চার্বাক দর্শন বলে যে, পরকাল বা আত্মার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই, তাই বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই। এই দর্শনের মূল কথা হলো, “যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ উপভোগ করো”, কারণ পৃথিবীর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সবই বর্তমান জীবনের অভিজ্ঞতা।

চার্বাক দর্শন দেহ ও জগতের প্রতি এক ধরনের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। এটি বিশ্বাস করে যে, জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সুখ অর্জন, এবং সেই সুখ অর্জনের জন্যই শারীরিক ও মানসিক তৃপ্তি লাভ করা প্রয়োজন। অতএব, এটি অন্যধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিধিনিষেধের প্রতি বিরোধী ছিল। লোকায়তদর্শন হিসেবে চার্বাক দর্শন মানুষের সাধারণ জীবন, বাস্তবতা ও জ্ঞানকে প্রধান্য দিয়ে চলা দর্শন হিসেবে পরিচিত। এই দর্শন আধ্যাত্মিকতা ও পরকালের ধারণাকে অগ্রাহ্য করে, সাধারণ জীবনকেই মূল বলে মনে করে।

চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের মতে, ধর্ম, অর্থ, কাম, ও মোক্ষের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার সঙ্গে বিপরীত। তারা এই বিষয়গুলোকে খুবই প্রাকৃতিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন। চার্বাকদের ধারণা অনুযায়ী:

1. ধর্ম: 

চার্বাকরা ধর্মকে অমূলক এবং মানুষের কল্পনা বলে মনে করতেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে ধর্মের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই, এটি শুধুমাত্র সমাজকে শাসন করার জন্য কিছু কুসংস্কার ও রীতিনীতি। ধর্মের ভিত্তিতে কৃত কোনো কর্মকে তারা ফলপ্রসূ মনে করতেন না। বরং তারা যুক্তির মাধ্যমে জীবনযাপনকেই গুরুত্ব দিতেন।

2. অর্থ:

 অর্থের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই বাস্তববাদী। তারা মনে করতেন যে জীবনধারণের জন্য অর্থ উপার্জন করা জরুরি, এবং এটি অবশ্যই বৈধ উপায়ে অর্জিত হওয়া উচিত। অর্থ উপার্জনকেই প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখতেন, কারণ অর্থের মাধ্যমেই সুখ ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব।

3. কাম

কাম বা চাহিদা পূরণকে তারা স্বাভাবিক ও বৈধ মনে করতেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে মানুষের প্রধান লক্ষ্য হলো তার ইন্দ্রিয় ও মানসিক চাহিদা পূরণ করা, যা জীবনের এক অংশ। চার্বাকরা এই বিষয়টি খোলামেলা এবং নৈতিক দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতেন।

4. মোক্ষ:

 চার্বাকদের মতে, মোক্ষ বা মুক্তির ধারণা ছিল একেবারে অমূলক। তারা বিশ্বাস করতেন যে মৃত্যুর পর কোনো আত্মার মুক্তি বা পুনর্জন্ম নেই। জীবনের শেষে মানুষের দেহটাই মাটি হয়ে যায়, আর কোনো আধ্যাত্মিক মুক্তির অস্তিত্ব নেই। তারা মানবজীবনকে একটাই উপলক্ষ হিসেবে দেখতেন, আর তাই পরকাল বা আধ্যাত্মিক মুক্তির চিন্তা তাদের কাছে অর্থহীন ছিল।

চার্বাকরা পৃথিবীকে বাস্তবিকভাবে দেখতেন এবং তাদের মতে, ধর্ম, মোক্ষ, পুনর্জন্ম এসব কিছুই অমূলক ধারণা। তারা জীবনকে সুখী ও সার্থক করতে চেয়েছিলেন প্রাকৃতিক নিয়ম ও যুক্তির মাধ্যমে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *