গণতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে জনগণের মুক্তচিন্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, যা রাষ্ট্রের কার্যক্রম ও ক্ষমতার প্রয়োগের প্রতি জনগণের নজরদারি নিশ্চিত করে। গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা, এবং এটি তখনই কার্যকর হতে পারে যখন রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি জনসাধারণের একটি স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। এ ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শুধুমাত্র ঘটমান ঘটনাগুলোর রেকর্ড বা রিপোর্টিংয়ের কাজ নয়, এটি সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক ব্যবস্থার গোপন বা অজ্ঞাত কার্যক্রম উন্মোচন করার জন্য কাজ করে, যা জনগণের দৃষ্টির বাইরে থাকে। এটি গণতান্ত্রিক সমাজে একটি অপরিহার্য উপাদান, কারণ এটি জনগণের জন্য সত্য এবং সুবিচারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
আসুন প্রথমে আলোচনা করি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রকৃতি কী। সাধারণত, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একটি প্রক্রিয়া যেখানে সাংবাদিকরা গভীর অনুসন্ধান ও অনুসন্ধানমূলক কাজের মাধ্যমে এমন ঘটনা বা তথ্য বের করেন যা সাধারণত জনগণের কাছে পৌঁছায় না বা এটি অবজ্ঞা করা হয়। এটি দীর্ঘ সময় ধরে তথ্য সংগ্রহ, সাক্ষাৎকার, দলিলপত্র বিশ্লেষণ এবং গোপন তথ্য উন্মোচনের মাধ্যমে করা হয়। এই ধরনের সাংবাদিকতা অধিকাংশ সময়েই সঠিক এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার জন্য সরকারের দুর্নীতি, প্রভাবশালী মানুষের অসৎ কার্যক্রম, অবিচার বা প্রশাসনিক ত্রুটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে থাকে।
একটি উদাহরণ হিসেবে, ১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে “ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল” এর কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সরকারের একটি বড় ধরণের দুর্নীতি প্রকাশ করেছিল। দুটি সাংবাদিক, বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টেইন, “ওয়াটারগেট হোটেল” এর প্রবেশের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন, যা ধীরে ধীরে প্রমাণিত হয়েছিল যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসন অবৈধভাবে নির্বাচনী প্রচারণা পরিচালনা করেছিল এবং গণমাধ্যমকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। এটি সাংবাদিকতার একটি অন্যতম বড় সাফল্য, যা তার পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্রের জন্য একটি বিশাল উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেবল একজন প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের কারণ সৃষ্টি করেনি, বরং এটি গণতন্ত্রে সরকারের প্রভাব এবং ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের একটি সুরক্ষা ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এছাড়াও, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালে “ইনফিনিটি স্ক্যান্ডাল” বা “ইনফিনিটি কর্পোরেশন কেলেঙ্কারি” ছিল একটি বড় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ঘটনা। দেশে যখন একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল, তখন কিছু সাংবাদিক বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনৈতিক অর্থ লেনদেনের অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন। তাদের অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ, রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিশাল আর্থিক দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসে। এই সংবাদটি দেশের রাজনীতি এবং প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গণসত্যের আলোচনার জন্ম দেয় এবং এটি সমাজের প্রতি সরকারের জবাবদিহিতা বাড়াতে সাহায্য করে।
এছাড়াও, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে এবং জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে। এটি রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের সমস্যা বা অসঙ্গতি উদঘাটন করার সুযোগ দেয়। গণমাধ্যম যখন দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বা পরিবেশগত সংকট নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তখন এটি কেবল সঠিক তথ্য প্রদান করে না, বরং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সৃষ্টি করে। এই ধরনের সাংবাদিকতা জনগণের সামনে সমস্যাগুলোর পরিচয় দেয় এবং তাদের সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, যা তাদের অধিকার রক্ষা করতে এবং প্রতিবাদ করতে উৎসাহিত করে।
তবে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সাংবাদিকদের প্রায়শই তাদের জীবন ও নিরাপত্তার ঝুঁকি নিতে হয়, কারণ তারা এমন বিষয়গুলোর অনুসন্ধান করতে যান যা রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চায় না যে জনগণ জানুক। এমনকি কিছু দেশে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য সাংবাদিকরা সরকারী হুমকি, শারীরিক আক্রমণ বা অন্য কোনো ধরনের প্রতিশোধের শিকার হন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালে মাল্টার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাফনি কারুয়ানা গ্যালিজিয়া নিহত হন, যিনি রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং ব্যবসায়িক স্বার্থের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখছিলেন। তার মৃত্যু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গুরুত্বকে আবারও প্রমাণিত করেছে।
তবে, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যেমন রয়েছে, তেমনি এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিরোধের এক শক্তিশালী মাধ্যম তৈরি হয়। জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশ, সরকারের প্রতি নজরদারি এবং দেশের শাসনতন্ত্রের প্রতি কর্তব্যপালন নিশ্চিত করতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অপরিহার্য। এটি শুধু যে সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে গণমুখী সংগ্রাম সৃষ্টি করে, তা-ই নয়, এটি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি, চেতনা এবং অবস্থা সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক।
এটি পরিস্কার যে, গণতান্ত্রিক সমাজে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রভাব অসীম। এটি শুধু একটি সৎ, নিরপেক্ষ এবং দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনই নয়, বরং এটি সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি সেই শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, যা জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা এবং সুবিচার রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট থাকে।