মানুষ আজকাল কৃষি থেকে তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এবং কৃষি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। কৃষকেরা কেন পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় যাচ্ছে অর্থাৎ আগে কৃষকেরা কষ্ট শর্তেও কৃষিকে পেশা হিসেবে ধরে রাখলেও বর্তমান প্রজন্ম কেন আর এই পেশায় থাকতে চাচ্ছে না।
চৌধুরী জান্নাতুন নাঈম
আমরা কৃষক সমাজ বলতে বুজে থাকি এমন জনগোষ্ঠীকে, যারা কৃষিকার্য পেশায় নিয়োজিত থেকে ফসল উৎপাদন করেন। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে এ পেশার মাধ্যমে কৃষক মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ করে জীবনকে চলমান রেখেছে। একজন কৃষক তাঁর নিজের জমিতে অথবা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কিংবা অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে ফসল উৎপাদনে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু বর্তমানে এমন কৃষক দেখা যায় না বরং এখন কৃষক বলতে মূলত যার নিজস্ব খামার বা জমি আছে তাকে বুঝায়। জমিতে নিয়োজিত কর্মীগণ খামার কর্মী, ক্ষেত মজুর ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়ে থাকেন।
আগে কৃষক বলতে যাদের বুঝাত, তারা ফসল উৎপাদন করে থাকতো নিজের পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই উৎপাদন করত। অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করে লাভবান হওয়া তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। পরিবারের চাহিদা মেটাতে তারা অল্প করে সব ধরনের ফসল উৎপাদন করত। কিন্তু বর্তমানে কৃষি এক ভিন্ন রূপ নিয়েছে, এখন আর কেউ শুধু পরিবারের চাহিদা মেটাতে ফসল উৎপাদন করে না বরং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়াই এখন মূল উদ্দেশ্য। ফলে কৃষক এখন এক জমিতে শুধু একই রকম ফসল উৎপাদন করে। আগে যেখানে এক জমিতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করতো।
এত পরিবর্তন হওয়া শর্তেও আজ আমরা দেখতে পাই কৃষি পেশা হুমকির মুখে। মানুষ আজকাল কৃষি থেকে তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এবং কৃষি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। কৃষকেরা কেন পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় যাচ্ছে অর্থাৎ আগে কৃষকেরা কষ্ট শর্তেও কৃষিকে পেশা হিসেবে ধরে রাখলেও বর্তমান প্রজন্ম কেন আর এই পেশায় থাকতে চাচ্ছে না। এই দুই প্রজন্মের চিন্তার মধ্যে পার্থক্য দেখা, তাদের ভাবনার/ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কি পরিবর্তন এসেছে তা বুঝা আমার প্রবন্ধের উদ্দ্যেশ্য। এর জন্য আমাকে আলোচনায় আনতে হবে, পেশা পরিবর্তন করে তারা কোন পেশায় যাচ্ছে, পেশা পরিবর্তন এর পিছনে মূল নিয়ামক বা কারণগুলো কি, পেশা পরিবর্তনের ফলে কিরূপ প্রভাব সমাজে পড়ছে পাশাপাশি কৃষক সমাজে পড়ছে এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনে পড়ছে তা দেখা। আমি আমার এই প্রবন্ধটি লিখতে যে গবেষণা কাজটি করেছি, সেখানে আমি দুই ধরনের গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করেছি (বিশদ সাক্ষাৎকার এবং কেস স্টাডি)।
কৃষি প্রধান দেশ হওয়া শর্তেও কৃষকরা আজ কৃষি থেকে তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কৃষকের সন্তান কৃষিতে আর নিয়োজিত থাকতে চায় না। শিক্ষিত হোক কিংবা অশিক্ষিত কৃষকসন্তান খালি চাকরি খোঁজে, বিদেশ যেতে চায়, ঢাকা বা অন্যান্য শহরে আসতে চায়। কৃষিতে কৃষক সন্তান আর আত্মস্থ হতে চায় না।
আবাদের সময় ও ফসল তোলার সময় শ্রমিকের অভাব দেখা যায় আজকাল। যাদের কৃষিশ্রমিক দরকার তারা তা পায় না। পাওয়া গেলেও শ্রমের দাম এত বেশি যে পোষায় না।
একজন কৃষিশ্রমিককে দৈনিক মজুরী দিতে হয় ৫০০ টাকা। আবার যে শ্রমিক কাজ করছে তার মজুরী বাইরে থেকে দেখলে বেশি মনে হলেও তারও পোষায় না যদি সুক্ষ্মভাবে আমরা দৈনন্দিন খরচের কথা ভেবে থাকি।
বি. কে. জাহাঙ্গীর (১৯৯৩) কৃষক সমাজের পৃথকীকরণ,মেরুকরণ ও বিরোধ প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে জমির উপর কৃষকের নিয়ন্ত্রন অসম। জমি পরিণত হয়েছে একটি পণ্যে। অল্পসংখ্যক কৃষক ধনী, অধিকাংশই দরিদ্র। ধনী কৃষকেরা যখন অর্থকরী শস্যের প্রতি কেন্দ্রীভূত, গরীব কৃষকেরা তখন ভোগ্য শস্য নিয়ে ব্যস্ত। কৃষিজ পণ্য বাজারে বিক্রি হয়। এই পণ্য সৃষ্টি হয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। মূলধন পুঁজিভূত হয়। এর কিছু অংশ কৃষি বর্হীভুত খাতে বিনিয়গ করা হয়।
এর মধ্যে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যাবহার ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যায়। জমি চাষ, সেচ, চারা রোপন, সার প্রয়োগ, আগাছা দমন, কীটনাশক প্রয়োগ, ফসল কর্তন, ফসল মাড়াই, ফসল ঝাড়ায়, ফসল শুকানো এবং গুদামজাতকরণ ইত্যাদি কাজে যন্ত্রের ব্যবহার আজ আর নতুন কোন বিষয় নয়। গ্রামীন কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে নিবিড় পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন শুরু করছে। গৃহস্থালীভিত্তিক উৎপাদনের গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে এবং খামারভিত্তিক উৎপাদনের সূত্রপাত ঘটছে। পূর্বে যে কৃষি উৎপাদন হতে সেক্ষেত্রে ‘আধুনিক প্রযুক্তি’র ব্যবহার ছিল না। কৃষকরা বাজার থেকে কোন প্রযুক্তি বা কৃষি উপকরণ ক্রয় করত না। কৃষি উপকরণ যেমনঃ বীজ, কীটনাশক, সেচ ব্যবস্থার প্রযুক্তি তারা নিজ গৃহ হতে সরবরাহ করত। ধনী কৃষক যাদের জমি ছিল তারা জমি বর্গা দিত বা গরীবদের নিয়োগ করে চাষাবাদ করত। এক্ষেত্রে চাষব্যবস্থা তদারকী করত জমির মালিক। এসময় বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ধান উৎপাদন হত। কৃষকরা যা অতিরিক্ত উৎপাদন করত তা স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করত। সব্জি বাগানের মালিকরাও নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত যা থাকতো তা বাজারে বিক্রি করত। কৃষি কাঠামোতে যখন থেকে ‘আধুনিক প্রযুক্তির’ বিস্তার ঘটতে থাকে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রের পরিবর্তন আসতে থাকে। দু’ধরণের প্রযুক্তি (যান্ত্রিক এবং রাসায়নিক) বাজার থেকে কৃষকদের সংগ্রহ করতে হয়। প্রযুক্তির মালিকানায় ধনীদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ধনীরা ট্রাক্টর, পাম্প, শ্যালো মেশিনের মতো যান্ত্রিক প্রযুক্তির মালিকানা লাভ করে। দরিদ্র কৃষকরা অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে প্রযুক্তির মালিকানা লাভ করতে ব্যর্থ হয়। দরিদ্ররা এ ধরনের প্রযুক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধনীদের নিকট থেকে তা ভাড়া নেয়। এখানে ‘আধুনিক প্রযুক্তি’র মালিক ও ব্যবহারকারীর মধ্যে একটি চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক তৈরী হয়। যেখানে প্রযুক্তি ভাড়া ও ব্যবহার নির্ধারিত থাকে। এছাড়া রাসায়নিক প্রযুক্তি যেমনঃ সার, বীজ, কীটনাশক সংগ্রহের জন্য বাজারের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। পূর্বে প্রাকৃতিক সার, বীজ, কীটনাশক তৈরী ও সংরক্ষিত হত গৃহে। যার জন্য নগদ অর্থের প্রয়জন হতো না। কৃষি উপকরণ ব্যয় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু ‘আধুনিক প্রযুক্তির’ ব্যবহার কৃষি ব্যয়কে বাড়িয়ে তোলে এবং পূর্বে যেখানে মানব শ্রম গুরুত্বপূর্ণ ছিল এখন তা প্রযুক্তি দ্বারা সম্পাদন করা হচ্ছে। এছাড়া ‘আধুনিক কৃষি’ পদ্ধতিতে বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পূর্বে যেখানে আউশ, বোরো, আমন ধান উৎপাদন হত, তা শুধু ইরি চাষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
ফলে দেখা যায় যে, দরিদ্র কৃষকেরা কৃষিকাজ ছেড়ে অন্যত্র শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত হতে শুরু করেছে। আবার কৃষক সন্তান চলে যাচ্ছে বিদেশ। উদ্দেশ্য উন্নত জীবন।
অধিকাংশ কৃষক সন্তান আজ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে চাকরী করছে। এতে দেখা যাচ্ছে যে, কৃষিতে একসময় ৭০-৮০ শতাংশ গ্রামীণ শ্রমিকরা নিয়োজিত থাকত। এখন তা ৩০-৪০ শতাংশে নেমে এসেছে।
আমার গবেষণাটি করতে গিয়ে, মাঠে কৃষকদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম যে, কৃষকেরা তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা পরিবর্তন করেছে বাধ্য হয়ে। আর তাদের যে কয়জন এখনো এই পেশা ধরে রেখেছে ভবিষ্যৎ এ তাও থাকবে না। অদূর ভবিষ্যৎ এ যদি আমাদের এই কৃষিপ্রধান দেশ থেকে যদি কৃষি পেশাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর এজন্য আমরা কৃষককে দোষারোপ করতে পারব না। কারণ, বর্তমানে কৃষকের যে দূরবস্থা, কৃষির যে দূরবস্থা, এতে করে কৃষি থেকে কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এটাই স্বাভাবিক।
আমার গবেষণার জন্য যে প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজতে গিয়েছিলাম, কৃষকেরা কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ঠিক কোন কারণগুলোর জন্য। আবার একজন প্রবীণ কৃষক কষ্ট হওয়া শর্তেও তার পূর্বপুরুষের পেশা কৃষি ধরে রাখলেও, তারা কেন চাচ্ছে না তাদের সন্তানেরা এই পেশায় থাকুক বা একজন এই প্রজন্মের তরুণই বা কেন থাকতে চাচ্ছে না এই পেশায়, যদিও এদের বেশিরভাগের নিজস্ব জমি রয়েছে। তা শর্তেও এরা কৃষি বিমুখ হয়ে যাচ্ছে।
আমি যখন মাঠে তাদের এই অনীহার কথা জানতে চাচ্ছি, তারা পাল্টা প্রশ্ন করতে শুরু করলো, তারা কেনো কৃষি কাজ করবে? তারা এরপর আমাকে একটা হিসেব দিলো, তাদের ফসল করতে ব্যয় হয় কত আর আয় কত। হিসেবটি নিচে তাদের ভাষ্যমতে যা ছিল হুবহু তুলে দিলাম বিশ্লেষণের সুবিধার্থে –
এক মণ ধান কৃষক বিক্রি করে পায় ৬০০ টাকা।
এক মণ ধান উৎপাদন করতে খরচ হয় হয় ২৪০০ টাকা (জমিতে কৃষিশ্রমিক নিয়োগ দেয়া হলে)।
এক মণ ধান উৎপাদন করতে সচরাচর খরচ হয় ১২০০ টাকা (জমিতে কৃষিশ্রমিক নিয়োগ না দিয়ে, জমির মালিক নিজে কাজ করলে)।
একজন কৃষিশ্রমিকে (স্থানীয় ভাষায় কামলার) দৈনিক মজুরী দিতে হয় ৫০০ টাকা (এই টাকার পরিমাণ একজন জমি মালিকের কাছে মনে হয় অতিরিক্ত খরচ। আবার অপর দিকে একজন কৃষিশ্রমিকের এই টাকায় দিন চলে না। ফলে এখন আর কৃষিশ্রমিক পাওয়া যায় না)।
এক গোন্ডা (ছয় শতাংশ) জমিতে ধান হয় তিন মণ।
এক গোন্ডা (ছয় শতাংশ) জমিতে ধান রোপনের(চারা) সময় খরচ হয় ২০০ টাকা।
প্রতি সিজনে সারের পিছনে খরচ হয় ৪০/৪৫ হাজার টাকা।
এছাড়াও রয়েছে কীটনাশক, বীজ, পানি, আল ইত্যাদির খরচ। আবার ফসল বিক্রি করতে গেলে সিন্ডিকেট করে কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য করে কৃষককে।
উপরের এই হিসেব দেখার পর, আমাদের আসলেই কৃষক আর তাদের জীবিকা নিয়ে পুনরায় ভাবতে হবে।
তারপর আবার দেখা যায়, সেচের পানির লাইন যতটুকুতে যায় ততটুকু জমিতে ফসল উৎপাদন হয়। তারপর মানুষের ‘কানি কানি’ (জমি পরিমাপের একক) পতিত জমি পড়ে আছে। এসব জমি তারা কোন কাজেই ব্যবহার করছে না। কারন, পানির সরবরাহ নাই। এসব জমির কোন মুল্যও নেই। আগে এসব জমির দাম (গোন্ডায়) ছিল এক লাখ বা সোয়া এক লাখ টাকা। আর এখন দাম হয়ে গেছে অর্ধেক।
আমরা জানি, কৃষি অফিসের লোকেরা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কাজ করে, ফসলের রোগ বালাই দেখে, কৃষককে পরামর্শ দেয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র তা না বরং বলা যায় তার উল্টো। তারা হয়ত বছরের দু-একবার যায়, কিছু ভিড্যু দেখায়ে চলে আসে। কিন্তু তাদের যে মাঠে গিয়ে রোগ দেখে পরামর্শ দেয়ার কথা তারা তা দেয় না। ফলে কৃষকেরা নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ফসলের কোন রোগ দেখলে কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকে। এতে কখন কাজ হয়, আবার কখন কাজ হয় না। এর কারণে পোকার আক্রমণের কারণে প্রায়ই কৃষকদের লোকসান গুণতে হয়।
যে চাল আমরা খাই ৫০/৬০ টাকা কেজি। আর সেখানে কৃষক পায় ১২/১৩ টাকা। আর আলুর কেজি প্রতি কৃষক পায় ১০ টাকা করে। পাট, ধানের দাম কমে যাচ্ছে দিন দিন। এছাড়াও ধান থেকে যে খড় পায় তাতেও লাভ নেই। বেশিরভাগ খড় পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর তেমন বাজার মূল্যও নেই। একজন কৃষক বললো, “ফসল বেচে যা পাইছি কোন রকমে কামলার টাকা দিতে পারবো।” আর যাদের জমির পরিমাণ কম তারা শুধু নিজের পরিবারের জন্য ফসল ফলায়, এর থেকে সংসার চালানোর মত আর কোন লাভ পায় না। বাজারে সব কিছুর দাম বাড়ছে অথচ কৃষকের দাম দিন দিন কমছে।
আবার দেশের মানুষ দিন দিন বাড়ছে কিন্তু জমি তো একই আছে। আগে যে জমিতে ৩/৪ মণ ফসল হতো, সেখানে এখন ৭/৮ মণ ফসল হয়। কিন্তু তাতেও কৃষকের লাভ হয় না। কারণ, জমি তো ভাগ হয়ে গেছে। আসলে জমি ভাগ হয়ে যাওয়া কৃষকের কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার একটি কারণ হলেও মূল কারণ হলো, কৃষিতে তো লাভ হচ্ছে না কৃষকের। কারণ, তাদের কানি কানি পতিত জমি পাড়ে আছে। আর এসব জমি নিয়ে তাদের কোন পরিকল্পনাও নেই। আগের প্রজন্মের যারা কৃষিতে এখনো আছে তারা বাধ্য হয়েই আছে। এই বয়সে এসে আর অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ নাই। আবার তাদের সন্তানেরাও অন্য পেশায় না যেতে পারলে বা শেষ বয়সে কিছু না করতে পারলে কৃষি কাজ করবে, এছাড়া তারা আর এই পেশায় থাকতে চাচ্ছে না।
কৃষির সাথে জড়িত অন্যান্য পেশাও এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন আর গোবরের ব্যবহার নাই। গরুও কমে গেছে। লাঙল নাই, এর ব্যবহারও নাই। কামারের পেশাও হারিয়ে যাচ্ছে। আবার যে গোলা বা হাড়িতে ধান রাখত, সিদ্ধ করত এখন আর তা দেখা যায় না। ফলে কুমোর ও হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বেতের পাটি, ধান রাখার বেতের গামলা এসব বাড়ির মা-বোনেরা তৈরী করত, সেই শিল্পও আজ বিলুপ্ত।
বর্তমান প্রজন্ম অন্যান্য পেশা হিসেবে “বিদেশ যাওয়াকে” এখন তারা সবচেয়ে প্রাধান্য দিচ্ছে। কৃষি জমি বিক্রি করে তারা এখন সেই টাকায় বিদেশ চলে যাচ্ছে। কষ্ট করে বিদেশ পাঠালে, একসাথে অনেক টাকা দেশে বাড়িতে পাঠায়। এই টাকা কাজে লাগাতে পারে। আগে বিদেশ থেকে টাকা পাঠালে জমি কিনত এখন আর কিনে না। এছাড়াও অনেকে মুরগীর খামার করে। আবার মাছের চাষে আয় বেশি হয়, তাই এই দিকে যাচ্ছে কৃষক। ধানের থেকে এখানে লাভ বেশি। তবে গরুর ফার্মে তেমন তারা আগ্রহী না, এখানে লাভ তেমন নেই। আবার অনেকে চায় আমি কৃষি কাজ করে কষ্ট করছি, আমার ছেলে মেয়ে পড়াশুনা শিখুক। অন্য লাইনে যাক, কিন্তু কৃষক সমাজের অন্যান্য মানুষ এই শিক্ষিত হওয়াকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে চায় না।
আবার জমির মালিকের কোন লাভ হয় না বলে, যারা প্রত্যক্ষ কৃষি না করে পরোক্ষ কৃষির সাথে জড়িত থাকতো জমি “বর্গা” বা “পোষানী” দিয়ে। এখন আর তাও দেয় না। এইক্ষেত্রে এক গন্ডায় মানে ছয় শতাংশে জমির মালিককে দেয় বছরে এক হাজার টাকা। বীজ সহ যাবতীয় খরচ যদিও মালিক দেয়। আবার জমির মোট চার ভাগের তিন ভাগ ফসল যে কৃষক কাজ করে তাকে দিয়ে দেয়া হয়। একভাগ ফসল নেয় জমির মালিক। তাও এখন আর কেউ বর্গা নেয় না। যে কৃষক জমিতে কাজ করে তার লাভ হয় না আবার জমির মালিকেরও লাভ হয় না। ফলে তাদের জমি পতিত হয়ে পড়ে আছে। আগে যেখানে দুই ফসল (ধান, পাট) একসাথে বুনতো, এখন সেখানে এক ফসল বুনে।
কৃষকের এই দূরাবস্থার কথা শুনে, কৃষির সাথে জড়িত সংস্কৃতির কি অবস্থা তা আর জিজ্ঞেস করার সাহস হয় নি পাশাপাশি আগ্রহও হয়নি। যেখানে তারা খাওয়ার জন্য অন্ন পায় না, সেখানে উৎসব এর বিলাসিতা মানায় না। কিন্তু তাদের কথা শুনে বুঝতে পেরেছি, কৃষির সাথে জড়িত সংস্কৃতিগুলো এখন বিলুপ্ত, এসব শুধু এখন বই পুস্তকেই রয়েছে।
কৃষির প্রতি আমার গবেষিত অঞ্চলের মানুষের এতটাই অনীহা চলে এসেছে যে, ফসলের ন্যায্যমূল্য পেলে কি কৃষিতে আপনাদের আগ্রহ আবার ফিরে আসবে? এর উত্তরে তারা জানিয়েছেন, “না”। কারণ, দুইদিন পর পর ফসল, বীজে নানা রকমের পোকা মাকড়ের আক্রমণ। যার ফলে তারা ফসলই তখন উৎপাদন করতে পারে না, ন্যায্যমূল্য তো পরের বিষয়। আমি বললাম আপনারা যদি কৃষি থেকে এভাবে বিমুখ হয়ে যান তাহলে ভবিষৎ এ দেশের কি হবে? একজন কৃষক এর উত্তরে বলেছে, “সৌদি কুয়েতেও তো কৃষি কাজ করে না, তারা খাইয়া বাঁইচা আছে না? বরং আমগো থেকে ভালো আছে ভালো খায়।”
রবি ফসল উৎপাদনে ঋণ দেয়া হয় পাঁচ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। ইরি, বোরো চাষে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়া হয়। এত কিছু পরেও কৃষকেরা কৃষি ছেড়ে দিচ্ছে তার প্রধান কারণ আমি গবেষণা করে পেয়েছি, কৃষি কাজ করে এখন আর তাদের লাভ হচ্ছে না, তাদের জীবন চলছে না। এছাড়াও রয়েছে শিক্ষার প্রশার, জমি ভাগ হয়ে যাওয়া, কৃষির সাথে জড়িত অন্যান্য উপাদানের দাম বেশি, ফসলের রোগ-বালাই, অন্যান্য পেশায় বেশি লাভ ইত্যাদি।
নিচে কয়েকটি কেস স্টাডি দেয়া হলো, যার থেকে আমরা বুঝতে পারবো এবং বিশ্লেষণ করতে পারবো, দুই প্রজন্মের কৃষি নিয়ে ভাবনা। আগের প্রজন্ম কৃষি ধরে রাখলেও, পরের প্রজন্ম কেন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এর জন্য প্রধান নিয়ামক হিসেবে কোন কারণটি বেশি কাজ করছে এবং তারা কোন পেশার দিকে ঝুঁকছে।
কেস স্টাডিঃ ০১
মোতাহার হোসেন নামক একজন দোকানদার জানায়, ওনার বাবা প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন, পাশাপাশি কৃষি কাজ করতেন। মোতাহেরেরা পাঁচ ভাই। আগে সারা বছরের ধান তাদের নিজেদের হতো। এখন জমি ভাগ হয়ে কমে যাওয়ায়, তারা এখন আর কৃষি কাজ করে না। কৃষি দিয়ে তাদের জীবন এখন আর চলে না। তাদের ভাইদের মধ্যে দুই ভাই বিদেশ থাকে, একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, আরেকজন সেনাবাহিনীতে আছেন আর তিনি নিজের দোকান দিয়েছেন। মূলত তাদের পরিবারে জমি ভাগ হয়ে কমে যাওয়ায় তাদের চাহিদা মিটাতে না পারায় এবং শিক্ষার অর্জনের মাধ্যমে অন্য পেশায় চলে যাওয়ার কারণে তারা এখন আর কৃষি কাজ করে না। তাদের যা জমি আছে তা আগে বর্গা দিত। আর এখন পোষানী হিসেবে জমি দিয়ে জমি থেকে মাত্র এক মৌসুমে পায় এক হাজার টাকা। যা পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে প্রত্যেকে ২০০ টাকা করে পায়। এখন আর জমি থেকে তারা কোন ফসলও পায় না। এসব কারণে তারা এখন আর কৃষিতে আগ্রহী না। তাদের পরিবার কৃষি ছেড়ে দিয়েছে এবং পরের প্রজন্ম শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে অন্য পেশায় চলে যাওয়াকে তাদের জীবিকা জন্য বেছে নিয়েছে।
কেস স্টাডিঃ ০২
শাহদাত নামের একজন কৃষি শ্রমিকের সাথে কথা বলার সময় জানায় যে, এখন আর বিভিন্ন ফসলের মৌসুমে জমি থেকে ফসল তোলার সময় কৃষি শ্রমিক বা কামলা পাওয়া যায় না। যদিও একজন কৃষিশ্রমিক হিসেবে তিনি দিনে ৫০০ টাকা মজুরী পায়। তারপরো তিনি নিজেও এখন আর এই কাজে যান না, যদি অন্যকাজের সুযোগ পায়। তিনি বলেন যে, দিনে ৫০০ পাই, বাইরে থেকে শুনলে মনে হয় অনেক টাকা। কিন্তু আমার দিনের খরচ শুনেন। সারাদিন কাজ করার পর সন্ধায় কোন দোকানে চা পানি খাইতে যায় ১০০ টাকা। বাজারে গিয়ে কোন মাছ কিনলে চলে যায় ২০০ টাকা। আবার খালি মাছ দিয়ে কি হবে কোন সবজি কিনতে হলে যায় ১০০ টাকা। জিনিস পত্রের যে দাম এখন। তারপর আমার কাছে আর কয় টাকা থাকে? ১০০ টাকা, এই টাকা দিয়ে আমি কি করবো? সঞ্চয় করবো নাকি ছেলেমেদের পড়াশুনা চালাবো আর অসুখ বিসুখ হলে তো উপায়ই নাই। এই কারণে এখন আর অন্য কাজ জুটাতে পারলে কামলা দিতে যাই না।
কেস স্টাডিঃ ০৩
শামসল নামক একজন কৃষক বলেন, আমার যে জমি আছে তাতে ৩৫/৪০ মোণ ধান হয়। আমার ছেলে মেয়ে ৩ জন। দুই ছেলে বিদেশ থাকে। আমার জমিতে যে ফসল হয় তা দিয়ে আমার পরিবারের চাহিদা শুধু মিটে। আমার আব্বার জমি ছিল অনেক তিনি যখন কৃষি কাজ করত তখন বাজারেও ফসল বিক্রি করত। একসাথে ধান আর পাট বুনত। একই জমিতে ২/৩ ধরনের ফসল হতো। তা দিয়ে নিজেদের পরিবারের সারাবছর চাহিদা মিটত পাশাপাশি বাজারে বিক্রিও করত। কিন্তু এখন জমি ভাগ হয়ে যাওয়ার কারণে যে ফসল হয় তাতে করে কেবল তাদের পরিবারের চাহিদা মেটে। ধান, পাটের দাম কমছে অথচ বাজারে নিত্যপ্রয়জনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। দুইদিন পর পর ফসলের রোগ বালাই হয়। আমার পাট গাছগুলাইতো এবার মরে যাচ্ছিল। পরে আমি চার কেজি সার এনে দিছি। আমি বুঝছি বলে সার দিছি, অনেকে তো বুঝতেও পারে না কি হইছে বা কি করবে। ফলে ফসল নষ্ট হয়ে আরো বেশি লোকসান হয়। এছাড়া ফসলের দাম নাই, ফসলের জমিরও দাম নাই। এইসব জমি এখন আর কেউ কিনে না, মাঠের জমিতে কেউ ঘরও বানায় না। আমার জমি থেকে মাটি কেটে আমি ঘর বাঁধছি, ফলে আমার জমি আরো নীচু হয়ে গেছে। ফলে এ বছর ফসল আরো কম হইছে। তারচেয়ে ভালো জমি বিক্রি করে আমার ছেলেদের বিদেশ পাঠায়ে দিছি। কষ্ট করে বিদেশ পাঠায়েও লাভ আছে, তারা একত্রে একটা ভালো পরিমাণ টাকা পাঠায়, যা আমরাও কোন কাজে লাগাতে পারি। আগে বিদেশ থেকে টাকা পাঠালে জমি কিনত মানুষ, এখন আর জমি কিনে না বরং অন্যকাজে লাগায়। ছেলেরা তো আর সারাজীবন বিদেশ থাকবে না যখন দেশে আসবে তখন যেনো কিছু করে খাইতে পারে সে ব্যবস্থা করে রাখছি।
কেস স্টাডিঃ ০৪
রাজ্জাক নামের একজন কৃষক তার নিজস্ব জমি আছে অনেক। তিনি তার জমিতে নিজে কাজ করেন এবং কৃষিশ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যখন তার ফসল বাজারে বিক্রি করতে গেলো তখন দেখলো তার মোণ প্রতি ধানে খরচ হয়েছে ২৪০০ টাকা, প্রতি কৃষিশ্রমিককে দৈনিক মজুরী দিতে হয়েছে ৫০০ টাকা। অথচ ধান বিক্রির সময় তাকে মোণ প্রতি ৬০০ টাকা করে ধান বিক্রি করতে হয়েছে। তিনি বলেন টেলিভিশনে দেখেছি কৃষক নিজের ফসলে আগুন দিয়েছে,আগুনতো দিবেই ধান বিক্রি করতে গিয়ে দেখে তার কোন লাভ হবে না যেই খরচ হয়েছে সে তুলনায়। তাই কষ্টে আগুন দিয়েছে। আমি নিজে ফসল বিক্রি করে যা পাইছি শুধু কামলার টাকাটা দিতে পারব আর কোন লাভ নাই। ধানের খড় পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে, আর যে কয়টা আছে তার কোন বাজার মূল্য নাই। আমার ছেলেদের বিদেশ পাঠায়ে দিছি, কৃষি কাজের পাশাপাশি আমার দোকান আছে। তাই আমার জমি থেকে মোটামুটি লাভ হলেও চলে। অনেক মানুষের কানি কানি জমি পড়ে আছে। লাভ নাই তাই ফসল করে না। এমন চলতে থাকলে, আমিও সামনে আর চাষ করবো না। জমি এইগুলা এমনেই পড়ে থাকবে। ছেলেরা বিদেশ থেকে এসে বুড়া বয়সে, যখন আমার মত হবে কিছু করতে পারবে না তখন আবার চাইলে কৃষি কাজ করবে।
কৃষি প্রধান এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনো কৃষিজীবী। একদিকে কৃষি জমির পরিমান সংকুচিত হচ্ছে, অপরদিকে বাড়ছে কৃষি উৎপাদন। এই সাফল্যের দাবিদার এদেশের কৃষক সমাজ। সুতরাং, কৃষকের আত্মপরিচয় সঙ্কট, মর্যাদাহীন পেশা, এটি লাভজনক পেশা নয়, কৃষি জমি অকৃষি খাতে ব্যবহার এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাদেরকে সম্মানের চোখে দেখতে হবে। সেই সংগে ফসলের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে কৃষকদের লোকসানের ঝুঁকি থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের কৃষকদের কৃষি বিমুখতা থেকে ফিরিয়ে এনে আমাদের কৃষক ও তাদের পেশা বাঁচিয়ে রাখতে পারবো।
তথ্যসূত্রঃ
পার্থ, রঞ্জন সাহা (২০০৭) “‘নতুন কৃষি’ ও বাংলাদেশের কৃষি কাঠামোর পরিবর্তন “, নৃবিজ্ঞান পত্রিকা, সংখ্যা ১২ পৃঃ ৬৩-৭৫, ২০০৭ নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
CHANDPUR TIMES, MAY 16, 2016.
Bangla24hour, May 14, 2019.
দৈনিক সিলেটের ডাক, ২৪ এপ্রিল, ২০১৯।
যুগান্তর, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮।
লেখকঃ
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
যোগাযোগঃ chowdhuryjunnatunnaim17@gmail.com
Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.
If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com