এথনোলজি বা মানববিদ্যা মানুষের আচরণ, সমাজ, সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন জনগণের জীবনযাত্রা অধ্যয়ন করে। সংস্কৃতি এই শাখার অন্যতম মূল বিষয় এবং এটি মানব সমাজের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সংস্কৃতির ধারণা বিশেষভাবে ঐতিহাসিকভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং একে বোঝার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভূত হয়েছে। সংস্কৃতি শব্দটি মানুষের চিন্তা, আচরণ, বিশ্বাস, অভ্যাস এবং ঐতিহ্যের সমষ্টি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংস্কৃতি এমন একটি একক শক্তি যা একটি সমাজ বা জনগণের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এটি একধরনের সামাজিক মর্যাদার প্রতিফলন, যা একেকটি জনগণের ইতিহাস, শখ, চিন্তা ও জীবনধারার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। মানুষের সংস্কৃতি তাদের চেতনামূলক এবং সামাজিক গঠনকে প্রভাবিত করে এবং এটি কেবল শারীরিক উপাদান বা নিদর্শন নয়, বরং এটি আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং মানসিক ধারণাও ধারণ করে।
এথনোলজিতে সংস্কৃতির ধারণা খুবই বিস্তৃত এবং এটি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। সংস্কৃতির ধারণা বিশ্লেষণ করার জন্য বিভিন্ন তত্ত্ব এবং দৃষ্টিকোণ রয়েছে। কিছু বিশেষ তত্ত্বের মধ্যে রয়েছে—ফাংশনালিজম, স্ট্রাকচারালিজম এবং কনস্ট্রাকটিভিজম। এই তত্ত্বগুলো সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক এবং তার মানুষের ওপর প্রভাব আলোচনা করে।
সংস্কৃতির ধারণা:
সংস্কৃতির মৌলিক দৃষ্টিকোণ হলো—এটি মানুষের আচরণ, জীবনধারা এবং পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত অভ্যন্তরীণ গঠন যা সবার জন্য একটি সামাজিক কাঠামো তৈরি করে। সংস্কৃতি বিশেষভাবে একটি শখের সমষ্টি, যা মানুষের অভ্যন্তরীণ মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, তাদের বিশ্বাস, নীতি, রীতিনীতি, ভাষা, এবং সামাজিক কনভেনশনগুলো নিয়ে গঠিত। যে কোনো জনগণের সংস্কৃতি সেই জনগণের মুল ভাবনা এবং তাদের শিকড়ের একেকটি পরিচিতি তৈরি করে।
সংস্কৃতির ভিত্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রীতি, অভ্যাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতি এবং পূর্বা সংস্কৃতির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। পশ্চিমা সমাজে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও স্বাধীন চিন্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে পূর্বের সমাজে পরিবার এবং সামাজিক দায়িত্ব বেশি গুরুত্ব পায়। এটি একটি বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক পার্থক্য যা সমাজের বিভিন্ন অংশের উপর প্রভাব ফেলে।
সংস্কৃতির বিবর্তন:
এথনোলজিতে সংস্কৃতির বিবর্তন অনেকটা একটি সামগ্রিক পরিবর্তন হিসেবে দেখা যায়, যা সময়ের সাথে সাথে মানব জাতির চিন্তা ও আচরণে পরিবর্তন আনে। একসময়, প্রাথমিক সমাজে, মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর নির্ভরশীল ছিল এবং তারা মূলত শিকারী বা সংগ্রাহক ছিল। কিন্তু কৃষিকাজের আবির্ভাবের সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং তারা এখন স্থায়ী বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে, শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তির উন্নতি এবং আধুনিকীকরণ সংস্কৃতির বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতের সংস্কৃতি প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। প্রাচীন ভারতে, ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু আধুনিক ভারতে, প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং বিজ্ঞান সংস্কৃতির দিক পরিবর্তন করেছে। ভারতের জনগণের চিন্তা-ভাবনা এবং সমাজে তাদের ভূমিকা আজকের দিনে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে।
সংস্কৃতির বৈশ্বিক পরিবর্তন এবং উদাহরণ:
বিশ্বায়নের ফলে সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সংস্কৃতির একে অপরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন হচ্ছে। একে বলা হয় সাংস্কৃতিক একীকরণ, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি একে অপরের সাথে মিশে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফাস্টফুড, মুঠোফোন, গ্লোবালাইজড ফ্যাশন এবং সোশ্যাল মিডিয়া এরই একটি প্রমাণ।
তবে, কিছু দেশ বা জনগণ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করার জন্য এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ঐতিহ্যবাহী ধারণাগুলি রক্ষা করার জন্য তারা পশ্চিমা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
সংস্কৃতির আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি:
আজকের বিশ্বে সংস্কৃতি একটি বহুমুখী, পরিবর্তনশীল এবং সম্পর্কিত ধারণা। এটি একটি সামাজিক কাঠামো হিসেবে মানুষের চিন্তা, আচরণ এবং সামাজিক সম্পর্কের গভীরতার প্রতিফলন। আধুনিক গবেষণায়, মানবিক মূল্যবোধ এবং সমাজের প্রতিটি অংশের মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্পর্ক খোঁজা হয়। উদাহরণস্বরূপ, টেকনোলজি এবং মিডিয়া সংস্কৃতির প্রতি তাদের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে সারা পৃথিবীজুড়ে মানুষের চিন্তা-ভাবনা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
কেস স্টাডি:
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির বিস্তৃতি এবং গঠন নিয়ে একটি কেস স্টাডি করা যেতে পারে। যেমন, আফ্রিকার আদিবাসী জনগণের সংস্কৃতি এবং তাদের সমাজের মধ্যে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আফ্রিকান সংস্কৃতির মধ্যে পুরাণ, ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে আদিবাসী জনগণের আচরণ নির্ধারিত হতো। কিন্তু আফ্রিকার ওপর কলোনিয়াল শাসনের পর, পশ্চিমা ধর্ম, শিক্ষা এবং প্রযুক্তির প্রভাব ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক চর্চাকে ধ্বংস করতে শুরু করে। আজকাল, আধুনিক প্রযুক্তি এবং পশ্চিমা সাংস্কৃতি আফ্রিকার জনগণের সংস্কৃতিতে এক ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। কিছু অঞ্চলে আদিবাসী জনগণ তাদের সংস্কৃতি এবং ভাষাকে পুনরুদ্ধার করতে কাজ করছে।
উপসংহার:
সংস্কৃতি মানব সমাজের অঙ্গ এবং এটি প্রতিটি জনগণের পরিচয় তৈরি করে। একে শুধুমাত্র ঐতিহ্য বা অভ্যাস হিসেবে নয়, বরং এটি চিন্তা, আচরণ এবং জীবনযাত্রার একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহ হিসেবে দেখতে হয়। মানব সমাজের বিবর্তনের সাথে সাথে সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়েছে এবং এটি সাম্প্রতিক সময়ে আরো বৈশ্বিক এবং আধুনিক হয়েছে। তবে, সংস্কৃতির রক্ষা এবং তার প্রকৃত পরিচয় নিয়ে অনেকে এখনও চিন্তা করেন এবং তা সমাজে নতুন উদ্ভাবনের জন্য এক নতুন অধ্যায় খুলতে পারে।