ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তায় সার্বভৌমত্ব (Sovereignty) একটি গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর তাত্ত্বিক বিষয়। এটি কেবল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শাসন বা পরিচালনা সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানবতার জন্য ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সমাজ পরিচালনার ধারণাও এতে অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী রাজনীতি ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ ও নৈতিকতার মধ্যে একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে, যেখানে সার্বভৌমত্বের ধারণা আল্লাহর একত্বের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী শাসন পরিচালনার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তায় সার্বভৌমত্বের প্রধান স্রোত হচ্ছে আল্লাহর বিধান, যার বিপরীতে মানুষের কল্পিত বা আত্মস্বীকৃত সার্বভৌমত্ব স্থান পায় না।
ইসলামে সার্বভৌমত্বের ভিত্তি আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক বা আমির (প্রধান) কেবল আল্লাহর প্রতিনিধিরূপে কাজ করে, এবং তার কর্তৃত্ব, ক্ষমতা বা আইন প্রণয়ন আল্লাহর ইচ্ছা ও কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী হতে হবে। এটি মুসলিম রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি, যেখানে রাজনীতি ও ধর্ম একে অপরের পরিপূরক। একদিকে রাষ্ট্রের শাসক কর্তৃত্ব চালাতে পারে, অন্যদিকে তাকে অবশ্যই কোরআন ও হাদিসের প্রতি আনুগত্য করতে হয়।
এটি এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো যা ‘আল্লাহর সার্বভৌমত্ব’ ধারণাকে কেন্দ্রে রেখে সমাজ পরিচালনার কথা বলে। ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, প্রকৃত সার্বভৌমত্ব কেবল আল্লাহরই। কোরআন এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে: “আসলে রাজত্ব (সার্বভৌমত্ব) শুধুমাত্র আল্লাহরই, তিনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দেন এবং যাকে ইচ্ছা রাজত্ব থেকে বঞ্চিত করেন” (কোরআন 3:26)। এই আয়াত থেকে প্রতিভাত হয় যে, রাজ্য বা শাসনের একমাত্র মালিক আল্লাহ। এতে বোঝানো হয়েছে, মানুষ বা কোনো রাষ্ট্র কোনো সৃষ্টিরূপে সার্বভৌমত্ব দাবি করতে পারে না, বরং আল্লাহর আদেশ ও নির্দেশের ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থা কার্যকরী হতে হবে।
ইসলামী রাষ্ট্রে শাসককে ‘খলিফা’ বা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খলিফা একদিকে যেমন ধর্মীয় শাসক, তেমনি রাষ্ট্রীয় শাসকও। তার কর্তব্য হলো মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা। তৎকালীন খিলাফতের সময়ে খলিফারা যেমন তাদের সিদ্ধান্তগুলো কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে নিতেন, তেমনি তাদের কাজ ছিল জনগণের ন্যায্য অধিকার রক্ষা এবং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আন্নু যখন শাসন শুরু করেন, তিনি মসজিদে একটি ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন যেখানে তিনি বলেন, “আমি তোমাদের উপর শাসন করবো, তবে যদি আমি আল্লাহর হুকুম ভুলে যাই, তোমরা আমাকে ঠিক করতে বাধ্য করবে।” এর মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করে জানান যে, শাসক কেবল আল্লাহর প্রতিনিধিই নয়, বরং জনগণের প্রতি তার দায়বদ্ধতা রয়েছে।
এছাড়া, ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে বিভিন্ন চিন্তাবিদদের মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেছে। বিশেষত, ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তাবিদ আবু হাসান আল-মাওয়ার্দী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “আল-আহকাম আল-সুলতানিয়াহ” (The Ordinances of Government)-এ রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি বলেন যে, রাষ্ট্র পরিচালনার সার্বভৌমত্ব আল্লাহর হাতে থাকে, এবং শাসককে আল্লাহর আইন অনুসরণ করতে হবে। তার মতে, রাষ্ট্রে শাসক ও জনগণের মধ্যে একটি চুক্তি থাকে, যেখানে শাসক আল্লাহর আইন অনুযায়ী শাসন চালাবেন, এবং জনগণ তাকে সমর্থন করবে, যদি সে ন্যায়ের পথে পরিচালিত থাকে। এই ধারণা ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তায় জনগণের অংশগ্রহণের গুরুত্বকে তুলে ধরে।
যদিও আল-মাওয়ার্দী এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক চিন্তাবিদরা সার্বভৌমত্বের ধারণাকে আল্লাহর বিধান অনুসারে সীমাবদ্ধ করেছেন, তবুও আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদরা এই বিষয়ের আরও আধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিশেষ করে, ২০ শতকের ইসলামী চিন্তাবিদ এবং রাজনৈতিক তাত্ত্বিক যেমন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি, তাঁদের মতাদর্শে ইসলামি রাষ্ট্রের কাঠামো এবং সরকারের আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া আরও স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। খোমেনি তাঁর “ভিলায়াত-ই ফকিহ” (Guardianship of the Islamic Jurist)-এ ইসলামী রাষ্ট্রের কাঠামো এবং শাসকের দায়িত্ব বিষয়ে আলোচনা করেন। খোমেনির মতে, আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রে একটি নির্দিষ্ট নেতা (ফকিহ) থাকবে যিনি ইসলামী আইন (শরিয়া) বাস্তবায়ন করবেন, এবং তাঁর এই ক্ষমতা জনগণের স্বীকৃতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হবে।
এই ধারণা অনুযায়ী, আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মূল ধারণা হলো, আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করতে হবে, তবে এই বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি বা সরকারও জনগণের জন্য দায়বদ্ধ। জনগণের সমর্থন ছাড়া এই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, এবং জনগণ যদি কোনো কারণে তাদের শাসককে ইসলামী আইন অনুযায়ী শাসন করতে না দেখেন, তবে তারা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে।
এছাড়া, ইসলামী রাজনীতি বা সার্বভৌমত্বের ধারণা অনুসরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হলো পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস। দেশটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই সার্বভৌমত্বের ধারণা ইসলামী নীতির আলোকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে, যদিও পাকিস্তানে রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিভিন্ন সময় পশ্চিমা রাজনীতির প্রভাবও লক্ষ্য করা গেছে। তবে দেশটির প্রাথমিক সময় থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনীতিকরা ইসলামী সার্বভৌমত্বের পক্ষে কাজ করেছেন এবং আজও পাকিস্তানে এই ধারণাটি খুবই প্রাসঙ্গিক।
ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তায় সার্বভৌমত্বের ধারণা আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, কারণ এতে আল্লাহর বিধান এবং মানবাধিকার, গণতন্ত্রের মতো ধারণাগুলির মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামিক রাষ্ট্রে যদি সম্পূর্ণভাবে শরিয়া আইন প্রণয়ন করা হয়, তাহলে কি এটি মানুষের স্বাধীনতা এবং আধুনিক মানবাধিকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে? এই ধরনের প্রশ্ন আজও বহু আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এছাড়া, আধুনিক যুগে, বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শের প্রভাবে, অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে আল্লাহর বিধান অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে, ইসলামী সার্বভৌমত্বের ধারণা ঐতিহাসিকভাবে সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সুবিচার এবং মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে পরিচিত। আজও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল অনুসরণ করার জন্য মুসলিম চিন্তাবিদরা এই ধারণাকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করছেন।
এভাবে, ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তায় সার্বভৌমত্বের ধারণা একটি বিশাল তাত্ত্বিক প্রশ্ন, যা ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বয় করে আধুনিক যুগে আরও গভীর আলোচনার দাবি রাখে। এটি কেবল ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং মানুষের অধিকার, রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সমাজের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।