ইসলামী আইন চিন্তাধারায় ইজমা (একত্মমত) এর ভূমিকা

ইসলামী আইন বা শরিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ আইনি ব্যবস্থা, যা কুরআন, হাদিস এবং বিভিন্ন ইজমা ও কিয়াসের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। এই আইন সমাজের আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সব দিককে নিয়ন্ত্রণ করে। শরিয়াতে বিভিন্ন ধারনার মাধ্যমে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ন্যায়, শান্তি এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য থাকে। ইসলামী আইনে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে ইজমা বা একত্মমত, যা হলো মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে কোনো একটি বিষয়ে একমত হওয়া। ইজমা ইসলামী আইন নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং এটি শরিয়াতে আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এই নিবন্ধে, আমরা ইজমার ধারণা, তার গুরুত্ব এবং ইসলামী আইন চিন্তাধারায় এর ভূমিকা আলোচনা করব।

ইজমা: ধারণা ও সংজ্ঞা

ইজমা আরবি শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ হলো “একত্মমত” বা “সর্বসম্মত সম্মতি”। ইসলামী আইন বা ফিকহের পরিভাষায়, ইজমা হলো এমন একটি সিদ্ধান্ত, যেখানে ইসলামী জনগণের বা বিশেষজ্ঞদের একটি গোষ্ঠী কোনো বিশেষ বিষয়ে একমত হন। এটি মূলত শরিয়াতে কুরআন ও হাদিসের পর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। যখন কোনো নতুন প্রশ্ন বা পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়, যা কুরআন ও হাদিসে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত নেই, তখন মুসলিম উলামারা তার সমাধান পেতে একত্রিত হন এবং ঐক্যমত্যে পৌঁছান। এই ঐক্যমত্য বা একমত হওয়াকে ইজমা বলা হয়।

ইজমা মূলত তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী আলেমদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি প্রক্রিয়া, যা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে শরিয়া আইন বা ইসলামিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলামী আইনটি কখনোই স্থির নয়; বরং এটি সময়, পরিস্থিতি এবং মানুষের চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অভিযোজিত হয়। ইজমার মাধ্যমে, নতুন বা অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় এবং শরিয়া আইন আরও পূর্ণাঙ্গ ও সুসংহত হয়।

ইজমার প্রকারভেদ

ইজমা সাধারণত দুইভাবে বিভক্ত করা হয়: একে “সাধারণ ইজমা” এবং “বিশেষ ইজমা” বলা যেতে পারে।

সাধারণ ইজমা হল এমন একত্মমত, যেখানে একাধিক উলামা বা ফকিহরা কোনো বিশেষ বিষয়ে ঐক্যমত হন, যেমন কুরআন ও হাদিসে উল্লিখিত নয় এমন একটি বিষয় বা প্রশ্নের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়া। এটি এমন পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ যেখানে একাধিক সম্মানিত চিন্তাবিদ ও আইনজ্ঞদের মাঝে মতের মিল পাওয়া যায়।

বিশেষ ইজমা হলো সেই ধরনের একমত, যেখানে শুধু একজন বিশেষজ্ঞ বা বিচারক তাদের মতামত দেন। তবে এটি সাধারণ ইজমার তুলনায় বেশি স্বীকৃত নয়, কারণ এর ভিত্তিতে ঐক্যমত্যের পরিমাণ কম থাকে।

ইজমার গুরুত্ব

ইজমা ইসলামী আইনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক অংশ। শরিয়ার আইন সঠিকভাবে ও সুবিবেচিতভাবে প্রয়োগ করার জন্য ইসলামী চিন্তাবিদরা ইজমা গঠন করেছিলেন। এটি ইসলামী আইনের দিকনির্দেশনা এবং বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ইজমার মাধ্যমে মুসলিম সমাজ তাদের আইনগত সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছে, বিশেষ করে যেসব সমস্যা কুরআন ও হাদিসে সরাসরি উল্লেখিত ছিল না।

ইজমার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি ইসলামী সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। যখন একটি বিষয় বা প্রশ্নের ওপর আলেমরা একমত হন, তখন তা পুরো মুসলিম সমাজের জন্য একটি সাধারণ নীতি বা দিকনির্দেশনা তৈরি করে। ইজমা মুসলিম সমাজের মধ্যে ঐক্য এবং সহযোগিতা শক্তিশালী করে এবং তা শরিয়ার বিধানকে আরও স্পষ্ট এবং শক্তিশালী করে তোলে।

ইজমার প্রক্রিয়া

ইজমার প্রক্রিয়া মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক কার্যক্রম। প্রথমত, কোনো প্রশ্ন বা পরিস্থিতি সামনে এলে, তা কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে সমাধান করা হয়। তবে যদি কুরআন ও হাদিসে তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ না থাকে, তখন মুসলিম চিন্তাবিদরা এই সমস্যার সমাধান বের করতে চেষ্টা করেন। তারা তাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং যুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছান। একাধিক চিন্তাবিদ বা আলেমদের সম্মতিতে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, সেটাই ইজমা। তবে, ইজমা কেবল তখনই কার্যকর হয় যখন এটি মুসলিম সমাজের সম্মানিত এবং অগ্রগণ্য চিন্তাবিদদের সম্মতির মাধ্যমে গৃহীত হয়।

ইজমা এবং শরিয়া আইন

ইজমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ইসলামী আইনে রয়েছে, কারণ এটি শরিয়া আইনকে আরও উন্নত ও যুগোপযোগী করে। ইসলামী আইন বা শরিয়া মূলত তিনটি প্রধান উৎসে নির্ভর করে: কুরআন, হাদিস এবং ইজমা। যদিও কুরআন ও হাদিস ইসলামী আইনের মূল ভিত্তি, তবুও নতুন পরিস্থিতি বা সমস্যার জন্য ইজমার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। ইজমা শরিয়া আইন নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে আইনের প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করে এবং এটি সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে বিকশিত হতে সহায়তা করে।

ইজমা, যেহেতু ইসলামী সমাজের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে, তা আইনগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটি সর্বজনীন নীতি বা দিকনির্দেশনা তৈরি করতে সহায়তা করে। ইজমার মাধ্যমে সিদ্ধান্তের স্পষ্টতা আসে এবং তা মুসলিম জনগণের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট নীতি বা আচরণের আদর্শ স্থাপন করে।

ইজমা ও ইসলামী সমাজ

ইজমা শুধু আইনগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নয়, বরং এটি ইসলামী সমাজের স্থিতিশীলতা এবং ঐক্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন একটি সিদ্ধান্ত বা নীতির বিষয়ে সম্মানিত আলেমগণ একমত হন, তখন তা পুরো মুসলিম সমাজের জন্য একটি মডেল বা রোল মডেল হিসেবে কাজ করে। এর ফলে সমাজে ঐক্য বজায় থাকে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতের মধ্যে একটি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইজমার মাধ্যমে ইসলামী সমাজে সুস্থ, শান্তিপূর্ণ এবং সমন্বিত পরিবেশ তৈরি হয়, যেখানে প্রতিটি মুসলিম একে অপরের মতামতকে শ্রদ্ধা করে এবং একযোগে শরিয়া আইন মেনে চলে। ইজমা শুধু আইনগত প্রসঙ্গেই নয়, বরং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সমাজে শৃঙ্খলা এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে।

উপসংহার

ইজমা ইসলামী আইনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি মুসলিম সমাজের মধ্যে ঐক্য এবং সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার একটি প্রধান মাধ্যম এবং শরিয়া আইনের একটি মূল ভিত্তি। ইজমার মাধ্যমে, ইসলামী চিন্তাবিদরা নতুন ও উদ্ভূত সমস্যার সমাধান বের করেন এবং ইসলামী আইনকে যুগোপযোগী ও প্রাসঙ্গিক করে তোলেন। ইজমা শরিয়াকে আরো কার্যকরী ও সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি মুসলিম সমাজে ন্যায়, শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে, ইসলামী আইন সর্বজনীন ন্যায়বিচারের দিকে এগিয়ে যায় এবং পুরো সমাজের কল্যাণে অবদান রাখে।

উৎস

  1. আল-কুরআন
  2. হাদিস
  3. “The Evolution of Ijma in Islamic Jurisprudence,” Dr. Muhammad Saeed al-Dusari
  4. “Principles of Islamic Jurisprudence,” Mohammad Hashim Kamali
  5. “Islamic Law: The Islamic Approach to Justice,” Ahmad al-Dweiri

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *