ইসলামি ধর্মতত্ত্বে একতা ও বৈচিত্র্য: সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ

ইসলাম একটি বিশাল ধর্মীয় পরিসর ধারণ করে, যা বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০ কোটি মানুষের জীবনধারাকে প্রভাবিত করে। ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি হলো একত্ববাদ (তাওহীদ), নবুওয়াত (নবী প্রেরণা), এবং আখিরাত (পরকালে বিশ্বাস)। তবে, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলনে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও, ইসলামি ধর্মতত্ত্বে কিছু মৌলিক বিষয় রয়েছে, যা সব মুসলিমের মধ্যে একতা সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে, ইসলামে বিভিন্ন মতবাদ, চিন্তাধারা ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রয়েছে, যা বৈচিত্র্যের জন্ম দিয়েছে। এই বৈচিত্র্য এবং একতা ইসলামি সমাজে ধর্মীয় চিন্তা ও আচার-আচরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইসলামি ধর্মতত্ত্বের একতা ও বৈচিত্র্য, বিশেষত সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ, মূলত দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত: শিয়া ও সন্নী মুসলিমরা। যদিও শিয়া ও সন্নী মুসলিমদের মধ্যে কিছু ধর্মীয় তত্ত্ব ও অনুশীলনে পার্থক্য রয়েছে, তবুও তারা মৌলিকভাবে একই ধর্মের অনুসারী, যা একতা এবং বৈচিত্র্যের একটি জটিল সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। এই নিবন্ধে, আমরা ইসলামি ধর্মতত্ত্বে একতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে সম্পর্ক এবং সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের কারণ এবং প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

একতা: ইসলামের মূল বিশ্বাস ও ঐক্য

ইসলামে একতা বা ঐক্যের ধারণা একটি কেন্দ্রীয় মৌলিক নীতি। ইসলামি ধর্মের ভিত্তি হলো আল্লাহর একত্ব (তাওহীদ), যার মাধ্যমে পুরো মুসলিম জাতির মধ্যে ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক একতা স্থাপন করা হয়। কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “তোমরা সবাই আল্লাহর রসূলকে অনুসরণ করো এবং তাঁর বিধানগুলির প্রতি বিশ্বাস রাখো” (সুরা আলে-ইমরান, 3:103)। এটি একধরণের ধর্মীয় ঐক্যের আহ্বান, যা প্রতিটি মুসলিমের মনে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদেরকে ইসলামের মূল আদর্শ অনুযায়ী একত্রিত করতে উৎসাহিত করে।

ইসলামে একতা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো “উম্মাহ”, বা মুসলিম সম্প্রদায়। ইসলাম মুসলিমদের এক বৃহৎ সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে সবাই একই ধর্মীয় আদর্শ এবং নৈতিকতা অনুসরণ করবে। এই ধর্মীয় ঐক্যের মূল ভিত্তি হলো মুসলিমদের মধ্যে সহিষ্ণুতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং পরস্পরের বিশ্বাস ও আচার-আচরণের প্রতি সম্মান। ইসলামে “ইখলাস” বা নিখাঁদ নিষ্ঠা এবং একতার ধারণা প্রতিফলিত হয়, যা মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি একক বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সমাজে শান্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।

বৈচিত্র্য: ইসলামে চিন্তাধারা ও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ

যদিও ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস এবং নীতিগুলি সব মুসলিমের মধ্যে একত্রিত করে, তবে ধর্মীয় চিন্তাভাবনা ও মতাদর্শের মধ্যে বৈচিত্র্যও বিদ্যমান। ইসলামি ইতিহাসে সময়-সীমার মধ্যে নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং ধর্মীয় কারণে কিছু ভিন্নধর্মী মতবাদ বা আন্দোলন জন্ম নিয়েছে। এর ফলে, মুসলিম সমাজে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ তৈরি হয়েছে। ইসলামের প্রথম যুগেই এই ভেদাভেদ শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এটি আরও জটিল হয়ে ওঠে।

শিয়া ও সন্নী মুসলিমদের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো নেতৃত্ব বা ইমাম নির্বাচনের বিষয়ে। সন্নী মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে, নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এর পরে মুসলিমদের নেতা নির্বাচিত করার পদ্ধতি ছিল পরামর্শ এবং সম্মতির ভিত্তিতে। তারা বিশ্বাস করেন যে, খলিফা হিসেবে প্রথম চারটি খলিফা (অর্থাৎ আবু বকর, উমর, উসমান, ও আলী) ইসলামের সম্প্রসারণ ও শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন। সন্নী মুসলিমদের মতে, ইসলামিক রাষ্ট্রের শাসক হতে পারে কেউ, যিনি আল্লাহর পথ অনুসরণ করেন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়েছেন।

অন্যদিকে, শিয়া মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে, নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এর পর মুসলিমদের নেতা বা ইমাম হিসেবে আলী (রঃ) এবং তাঁর বংশধরেরাই যোগ্য। তারা মনে করেন, নবীর পরবর্তী নেতৃত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ছিল এবং এটি আলী (রঃ)-এর মাধ্যমে মুসলিমদের কাছে পৌঁছাতে হবে। শিয়া মুসলিমদের মতে, ইমামদের মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা ও মর্যাদা রয়েছে, যা সন্নী মুসলিমরা স্বীকার করেন না। এই মতভেদ ইসলামের ইতিহাসে একটি বড় ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করেছে এবং শিয়া ও সন্নী মুসলিমদের মধ্যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছে।

সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের কারণ

ইসলামি সমাজে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের উৎপত্তির পেছনে অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম সমাজের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সংঘাতের ফলে অনেক মতাদর্শের উত্থান হয়েছে। বিশেষ করে, ইসলামের প্রথম শতক থেকে পরবর্তী যুগে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি লড়াই এবং সঠিক নেতৃত্বের বিষয়ে বিভ্রান্তি ছিল। খলিফা নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে বিভক্তি তৈরি হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত শিয়া এবং সন্নী মুসলিমদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ তৈরি করেছে।

এছাড়া, সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও মতবিরোধ ইসলামের বিভিন্ন স্কুল অফ থট (মাদহাব) এর মাঝে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন, হানফি, মালিকি, শাফি, এবং হাম্বলি মাদহাবের মধ্যে ধর্মীয় বিধান ও অনুশীলনের ভিন্নতা রয়েছে। যদিও এই ভিন্নতা খুবই সাদাসিধে এবং মানবিক, তবুও একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার অভাব সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কারণ হতে পারে।

একতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে সমঝোতা

ইসলামে একতা এবং বৈচিত্র্য একে অপরের পরিপূরক হতে পারে, যদি মুসলিমরা তাদের বিশ্বাস ও অনুশীলনের মধ্যে সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখে। কুরআনে সুরা আল-হুজুরাত (49:10) এ বলা হয়েছে, “মুমিনরা তো একে অপরের ভাই।” এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামে মুসলিমদের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি হলো ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক, যা একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, শ্রদ্ধা, এবং সহযোগিতার প্রতীক।

মুসলিম সমাজে বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান রাখা এবং একে অপরের ভিন্ন মতাদর্শ ও বিশ্বাসকে সম্মান জানানোই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা। শিয়া ও সন্নী মুসলিমদের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠিত করা, আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং ইসলামের মৌলিক নীতির প্রতি একনিষ্ঠতা বজায় রেখে সম্ভব। এর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং বিভেদ কাটিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

উপসংহার

ইসলাম একটি ধর্ম, যা একতা ও বৈচিত্র্যের মাঝে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শিয়া ও সন্নী মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ভেদাভেদ থাকা সত্ত্বেও, ইসলাম তাদেরকে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহনশীলতা বজায় রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো আল্লাহর একত্ব এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্য, যা সকল ভেদাভেদ ও মতানৈক্য সত্ত্বেও একটি বৃহত্তর শান্তি ও ঐক্যের দিকে পরিচালিত করতে পারে।

উৎস

  1. কুরআন, সুরা আল-হুজুরাত (49:10)
  2. হাদিসের সংকলন
  3. ইসলামি দর্শন ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন, ড. মুহাম্মদ ইব্রাহিম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *