ইসলামি আইন (ফিকহ) মুসলিম সমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যা ধর্মীয়, সামাজিক এবং নৈতিক দিক থেকে জীবন পরিচালনার নির্দেশিকা প্রদান করে। তবে, এটি দীর্ঘকাল ধরে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, এবং অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টির কারণে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামিক ফিকহের ফেমিনিস্ট ব্যাখ্যা এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যা নারীদের অধিকার এবং সাম্যতার দিকে মনোযোগ দিয়ে ইসলামী আইনকে পুনর্বিবেচনা করার চেষ্টা করে।
ইসলামে নারীর অবস্থান ও অধিকার সংক্রান্ত আইনসমূহ অনেক সময়ই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু আধুনিক ফেমিনিস্ট ভাবনা ও চিন্তা-ধারার প্রভাবে ইসলামী আইনশাস্ত্রের ভেতরে নারীদের জন্য ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন, কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা পরস্পরের জন্য নিরাপদ সহকারী” (কোরআন 9:71)। এর মাধ্যমে মেয়ে-পুরুষ উভয়কে সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। তবে, এটি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়ে বিভিন্ন মুসলিম সমাজে বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়ন দেখা যায়।
ফেমিনিস্ট ব্যাখ্যা যেহেতু নারীর অধিকার, স্বাধীনতা ও মর্যাদার দিকে মনোযোগ দেয়, তাই তারা ইসলামী আইন ও বিধানকে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করে। তাদের মতে, ইসলামী আইন নারীর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন সমর্থন করে না, বরং ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে এটি কিছু ক্ষেত্রে নারীর প্রতি অবিচার করেছে। ইসলামী আইনশাস্ত্রের ফেমিনিস্ট ব্যাখ্যা এই ধরনের অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার, এবং তারা নারীদের অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ইসলামী বিধির সংশোধন চায়।
এখন প্রশ্ন ওঠে, ইসলামী আইন কি আসলেই নারীদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে? ফেমিনিস্ট চিন্তাবিদরা এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময়, তারা মূলত কোরআন ও হাদিসের মৌলিক নীতিগুলোকে সামনে আনে। তারা বলেন, ইসলামে নারীর জন্য অনেক অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল, যেমন ধর্মীয় স্বাধীনতা, বংশগত অধিকার, শিক্ষা গ্রহণের অধিকার, এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। উদাহরণস্বরূপ, কোরআনে নারীদের বিয়ে, পিতৃত্ব এবং সম্পত্তি উত্তরাধিকার সম্পর্কিত অনেক আয়াত রয়েছে, যা নারীদের অধিকার নিশ্চিত করে।
তবে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলামিক সমাজগুলোতে পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রভাবে নারীদের অধিকার যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। কোরআনের পরিভাষার মধ্যে যা স্পষ্টভাবে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বলেছে, তা অনেক সমাজে তেমনভাবে প্রভাবিত হয়নি। বিশেষ করে, ইসলামী আইনের পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা প্রভাবিত হয়ে নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এক্ষেত্রে, ইসলামী আইনশাস্ত্রের ফেমিনিস্ট ব্যাখ্যা বিশেষ গুরুত্ব পায়, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও নৈতিকতা অনুযায়ী নারীদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে।
ফেমিনিস্ট ব্যাখ্যাকারীরা এই কথা বলেন যে, কোরআন এবং হাদিসের মাধ্যমে যে নারীর অধিকার ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে, তা সঠিকভাবে বোঝা না গেলে নারীদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টির সুযোগ থাকে। উদাহরণস্বরূপ, কোরআনে নারী ও পুরুষকে সমানভাবে ঈমানের দিক থেকে মূল্যায়ন করা হয়েছে, এবং ইসলামের প্রথম যুগে বহু নারী সাহাবী সমাজে সক্রিয় ছিলেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঐতিহাসিকভাবে, বিশেষ করে ৭ম শতকের পর, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে নারীর অধিকারের ব্যাপারে কিছু ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে, যা আজও কিছু মুসলিম সমাজে প্রভাবিত।
ফেমিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইসলামী আইনশাস্ত্রের আরও একটি বড় বিষয় হলো ‘মহিলা নেতৃত্ব’। কোরআন ও হাদিসে যদিও পুরুষদের নেতৃত্বের বিষয়টি বারবার এসেছে, তবে নারীর নেতৃত্বের বিষয়ে যথাযথ আলোচনা খুব একটা নেই। ফেমিনিস্ট ব্যাখ্যাকারীরা মনে করেন যে, ইসলাম নারীদের নেতৃত্বের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে তা সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
মুসলিম সমাজে কিছু দেশে যেমন সৌদি আরব, মহিলাদের জন্য গাড়ি চালানো, ভোট দেওয়া, বা সরকারি কাজে অংশগ্রহণের মতো অধিকারে সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু এসব বিষয়েও ইসলামিক ফেমিনিস্টরা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তারা বলেন, এসব সংস্কৃতিক প্রভাব, যে কারণে নারীদের স্বাধীনতা খর্ব হয়, তা ইসলামী নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আধুনিক ফেমিনিস্ট ইসলামি চিন্তাবিদরা এসব সংস্কৃতি পরিবর্তন এবং নারীর সাম্য, অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।
একটি উল্লেখযোগ্য কেস স্টাডি হলো, মিসরের ইসলামিক চিন্তাবিদ নওয়াল আল-সাদাওই, যিনি ইসলামে নারীর অবস্থান নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন এবং নারী স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের জন্য ইসলামের মৌলিক সূত্রের ভিত্তিতে নানা প্রস্তাবনা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ইসলাম নারীকে সমান অধিকার প্রদান করেছে, তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কিছু কুসংস্কার ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, যা নারীদের অধিকারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, ইসলাম নারীকে তার শরীরের, তার সম্পত্তির এবং তার ব্যক্তিগত জীবনের পুরোপুরি অধিকার দিয়েছে।
এছাড়া, পাকিস্তানি নারী অধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাইও ইসলামের নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়ে নারী শিক্ষার প্রচারে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসলামী নীতির ভিত্তিতে নারীদের শিক্ষার অধিকারের কথা তুলে ধরেছেন এবং নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত ইসলামের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
অতএব, ইসলামী আইনশাস্ত্রের ফেমিনিস্ট ব্যাখ্যা এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যা ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী নারীদের জন্য সমতা, অধিকার এবং ন্যায়বিচারের দাবি করে। এটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের বাইরেও নারীদের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তন করতে সক্ষম।