যুদ্ধ ও শান্তি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দুটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সমান্তরাল ধারণা। একটি দেশের আরেকটি দেশের সাথে যুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক সুবিধা অর্জনের চেষ্টা করা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং সংলাপের প্রক্রিয়া – এগুলোই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল কাঠামো। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্বগুলোর মধ্যে যুদ্ধ এবং শান্তি সম্পর্কিত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের, কূটনীতিকদের এবং বিশ্বের নেতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।
এই নিবন্ধে, আমরা যুদ্ধ এবং শান্তির তত্ত্বগুলোর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, এর ইতিহাস, উদাহরণ এবং গুরুত্বপূর্ণ কেস স্টাডির আলোকে বিশ্লেষণ করব।
যুদ্ধের তত্ত্ব
যুদ্ধের তত্ত্ব বা “Theory of War” আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যুদ্ধের তত্ত্বে মূলত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে— রিয়ালিজম, লিবারালিজম, এবং কনস্ট্রাক্টিভিজম। এই তত্ত্বগুলো যুদ্ধের কারণ এবং এর পরিণতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রদান করে।
১. রিয়ালিজম (Realism) তত্ত্ব
রিয়ালিজম তত্ত্বের মতে, যুদ্ধ মানব সমাজের একটি অবশ্যম্ভাবী উপাদান এবং রাষ্ট্রের নিজস্ব নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ একটি প্রয়োজনীয় মাধ্যম। রিয়ালিস্টরা বিশ্বাস করেন যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জগতে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না, কারণ রাষ্ট্রগুলি তাদের নিজস্ব স্বার্থের জন্য একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করে। এ কারণে, এই তত্ত্বের অন্তর্গত জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও সংলাপ যতই শক্তিশালী হোক, যুদ্ধকে এড়ানো সবসময় সম্ভব নয়।
রিয়ালিজমের অন্যতম বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ছিলেন থমাস হবস, যিনি “লেভিয়াথান” গ্রন্থে বলেছেন, “মানব প্রকৃতি এমন, যে রাষ্ট্রগুলি নিজেদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিযোগিতা করবে এবং তা যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে।” উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) ছিল রিয়ালিজম তত্ত্বের বাস্তব উদাহরণ। যখন নাৎসি জার্মানি তার বিস্তার প্রক্রিয়া শুরু করে, তখন অন্যান্য দেশগুলো তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধ বাধানোর জন্য প্রস্তুত ছিল।
২. লিবারালিজম (Liberalism) তত্ত্ব
লিবারালিজম তত্ত্বের দৃষ্টিতে, যুদ্ধ কখনোই অবশ্যম্ভাবী নয় এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক এবং সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এই তত্ত্বের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, যদি রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং তারা একে অপরের সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে সহযোগিতা করে, তবে যুদ্ধের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে।
এটি জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সংলাপের ভিত্তি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি যেমন, প্যারিস চুক্তি (১৯৪৭) বা জেনেভা কনভেনশন যুদ্ধের সময় মানবাধিকার রক্ষা এবং যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য এই তত্ত্বের অন্যতম উদাহরণ। একটি ভালো উদাহরণ হল, ১৯৯১ সালের গালফ যুদ্ধ, যেখানে বিশ্বব্যাপী শক্তি ব্যবহারের বদলে জাতিসংঘের আওতায় সমাধান আনার চেষ্টা করা হয়েছিল।
৩. কনস্ট্রাক্টিভিজম (Constructivism) তত্ত্ব
কনস্ট্রাক্টিভিজম তত্ত্বের মূল ধারণা হল যে যুদ্ধ বা শান্তি কোনটি রাষ্ট্রের ভিতরকার সামাজিক ধারণা, সংস্কৃতি, পরিচয়, এবং বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। এই তত্ত্বের মতে, রাষ্ট্রগুলোর আচার-আচরণ এবং তাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় তাদের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক পরিচয়, এবং একে অপরের প্রতি অনুভূতির ভিত্তিতে। কনস্ট্রাক্টিভিস্টরা মনে করেন, যদি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইতিবাচক সংস্কৃতি ও সম্পর্কের একটি পরিবেশ তৈরি হয়, তবে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব।
একটি উদাহরণ হতে পারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) সৃষ্টি। যেখানে বিভিন্ন যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলি, যেমন ফ্রান্স এবং জার্মানি, নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। কনস্ট্রাক্টিভিজম তত্ত্ব এই ধরনের ঘটনা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, যেখানে রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক সম্পর্ক যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।
শান্তির তত্ত্ব
শান্তির তত্ত্বও যুদ্ধের তত্ত্বের মতোই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি অপরিহার্য অংশ। শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন তত্ত্ব ও কৌশল ব্যবহার করা হয়। শান্তির তত্ত্বের মধ্যে প্রধানত তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে: আর্কিটেকচারাল পিস (Architectural Peace), প্যাকিফিকিজম (Pacifism), এবং পজিটিভ পিস (Positive Peace)।
১. আর্কিটেকচারাল পিস (Architectural Peace)
এই তত্ত্বের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, শান্তি শুধুমাত্র যুদ্ধের অনুপস্থিতি নয়, বরং এটি একটি সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা যা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, ন্যায়, এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, যা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে আনে।
২. প্যাকিফিকিজম (Pacifism)
প্যাকিফিকিজম তত্ত্ব যুদ্ধকে পরিত্যাগ করার এবং এটি প্রতিরোধ করার জন্য নৈতিকভাবে প্ররোচিত করে। প্যাকিফিকিজমের অনুশীলনকারীরা বিশ্বাস করেন যে, যুদ্ধ মানুষের মৌলিক অধিকার এবং নৈতিকতার প্রতি বিরোধী। ১৯৩০ এর দশকে মহাত্মা গান্ধী তার অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। গান্ধীর মতে, শান্তি কেবল যুদ্ধ না করা নয়, বরং মানুষের মধ্যে শান্তির ধারণা ও আচরণ স্থাপন করা।
৩. পজিটিভ পিস (Positive Peace)
পজিটিভ পিস তত্ত্ব শান্তির ক্ষেত্রে শুধু যুদ্ধের অনুপস্থিতি নয়, বরং একটি প্রতিষ্ঠিত সুশাসন, ন্যায়বিচার এবং সমৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা মনে করেন, যুদ্ধের পরিপন্থী শান্তি অর্জনের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতি করা উচিত। একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে, ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যা পরবর্তী শান্তি প্রক্রিয়া, যেখানে দেশটি যুদ্ধের পর শান্তিপূর্ণ পুনর্নির্মাণের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা পেয়েছিল।
কেস স্টাডি: ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করেছিল, দাবি করা হয়েছিল যে সাদ্দাম হোসেন নিষিদ্ধ অস্ত্র তৈরি করছে। কিন্তু এই যুদ্ধের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রিয়ালিজমের তত্ত্বের প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে ছিল, যদিও আন্তর্জাতিক আইনের নিরিখে এটি অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল। শান্তি প্রতিষ্ঠার তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই যুদ্ধটি যথাযথ আইনি বা নৈতিক অনুমোদন পায়নি, কারণ এটি সংঘটিত হয়েছিল একটি একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে, যা পরবর্তীতে অঞ্চলটিতে বিশাল অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে।
উপসংহার
যুদ্ধ এবং শান্তি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দুটি অপরিহার্য বিষয়। যুদ্ধের তত্ত্ব যেমন রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সংঘর্ষের কারণ এবং পরিণতি বোঝায়, তেমনি শান্তির তত্ত্ব আমাদের দেখায় কিভাবে সহযোগিতা, ন্যায়বিচার এবং সম্মানজনক সম্পর্কের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বিভিন্ন দার্শনিক ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধ এবং শান্তির তত্ত্বের আলোচনা আমাদের বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এক মূল্যবান দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।