ব্যক্তি যখন বাধ্য হয়ে কিংবা নিজ ইচ্ছায় ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ভাষার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠে সে তার শেকড় থেকে অর্থাৎ তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকা সেই মাতৃভাষা থেকেই দূরে সরে যায়।

আফিয়া বিনতে লতিফ শান্তা
পর্ব-২
আঞ্চলিক ভাষা চর্চায় অবহেলা…..
আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বলুন তো মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম কি? খুব সহজ, সুন্দর এবং সাবলিল ভাবেই হয়তো আপনি উত্তর দিবেন- ‘ভাষা’। যদি আরো স্পেসিফিকালি জানতে চাওয়া হয় কোন ধরণের ভাষা? অবশ্যই উত্তর আসবে ‘মাতৃভাষা’। মাতৃভাষা শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা এভাবে- মায়ের মুখ নিঃসৃত ভাষা। অর্থাৎ ‘মা’ যে ভাষায় কথা বলেন সেটিই মাতৃভাষা যেটি সদ্য জন্ম নেয়া একজন শিশু ধীরে ধীরে আয়ত্ত করার মাধ্যমে বেড়ে উঠে এবং পরবর্তীতে নিজ মনোভাব প্রকাশে ব্যবহার করে।
বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর নিকট এই মাতৃভাষাকে অন্য সংস্কৃতির চাইতে অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় বাংলা ভাষা অর্জনের ইতিহাসের সাথে যুক্ত করে দেখবার জন্যে।
আজকাল বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একধরণের স্ট্যান্ডার্ড মাধ্যমকে গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে এই স্ট্যান্ডার্ড মাধ্যমের ধরণেও বদল ঘটছে প্রতিনিয়ত।
একটা সময় অব্দি ‘শুদ্ধ’ বাংলা ভাষার প্রচলনের দ্বারা অর্থাৎ যে মাধ্যমে বই-পত্র লিখালিখি কিংবা সংবাদপাঠ করা হতো, তাকেই ‘শুদ্ধ ভাষা’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো সেখানে বর্তমানে স্থান করে নিয়েছে ‘বাংলিশ’ ভাষা বা যাকে বলতে পারি বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার মিশ্র ব্যবহার।
অর্থাৎ এ ধরণের স্ট্যান্ডার্ড ভাষার মানদণ্ড নির্মাণে শুধুমাত্র শুদ্ধ বাংলা ভষার যে ব্যবহার ছিলো সেটি কমে গিয়েছে সেখানে বাংলা শব্দের পাশাপাশি এসেছে ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা। এই স্ট্যান্ডার্ড মাধ্যমে যারা বাক-বিতন্ড করে, প্রতিদিন পরস্পরের সাথে কথা বলার মাধ্যমে নিজ মনোভাব প্রকাশ করে তারা একটা ‘স্মার্ট’ গোষ্ঠীর অন্তর্গত হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ‘স্মার্ট’ গোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষা অন্যদের প্রভাবিত করে নিজের ভাষাকে পরিমার্জিত করার ক্ষেত্রে। এখানে নিজের ভাষাকে পরিমার্জিত করার প্রসঙ্গ এজন্যই আসলো কেননা প্রতিটি ভাষারই আঞ্চলিক কিছু ক্যাটাগোরাইজেশন থাকে। যেমনটা আছে বাংলা ভাষাতেও। জীবন-জীবিকার জন্যে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। এসব অঞ্চল ভিত্তিক মানুষের ভাষার ধরণও হয় বেশ ভিন্ন, কখনো শব্দের ব্যবহারে কিংবা আঞ্চলিকতার টান কিংবা কথার মাধ্যমে থেকে যায়।যখন কোনো সুনির্দিষ্ট ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমকে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ধরে নেয়া হয় তখন ভাষার ব্যবহারের বিভিন্নতা হারিয়ে যায় অর্থাৎ তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক যে ভাষার চর্চা প্রতিষ্ঠিত ছিলো সেটির বদল ঘটে এবং সে সাথে দীর্ঘদিনের চর্চাহীনতায় ফলে উক্ত ভাষা হারিয়ে যায়। এই হারিয়ে যাওয়া ভাষা গুলোরই একটি অংশ হচ্ছে ‘আঞ্চলিক ভাষা’।
আমাদের জীবনে যা কিছু বহাল থাকে তার প্রায় সকল কিছুই প্রতিনিয়ত চর্চিত হয়। আপনি খেয়াল করবেন আপনার খুব প্রিয় কোন কাজ বা অভ্যাস একনাগারে বেশ কিছুদিন না করার ফলে আপনার কাজটির সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হবে। একটা সময় আপনি সেখান থেকে এতোটাই দূরে সরে যাবেন যে সেটির প্রতি আর কোনো আকর্ষণই আপনার হয়তো কাজ করবে না। আঞ্চলিক ভাষার সাথে দূরত্বটাও খুব সম্ভবত এভাবেই তৈরি হয়। ব্যক্তি যখন বাধ্য হয়ে কিংবা নিজ ইচ্ছায় ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ভাষার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠে সে তার শেকড় থেকে অর্থাৎ তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকা সেই মাতৃভাষা থেকেই দূরে সরে যায়। এখানে অবশ্য প্রশ্ন থেকে যেতে পারে যে উক্ত ব্যক্তি তো তার মাতৃভাষাতেই কথা বলছে তাহলে কি করে শেকড় থেকে ছিটকে যাওয়ার প্রসঙ্গ আসলো। এখানে বরঞ্চ ভিন্ন আঙ্গিকে দেখলে উত্তরটা বেশ সহজ হয়, যে ব্যক্তি সিলেট অঞ্চলে বেড়ে উঠেছে সেখানে তার স্থানীয় ভাষায় ভাব প্রকাশের যে মাধ্যম সেটিকে তার মাতৃভাষা হিসেবে চিহ্নিত করছি। অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষাও যে মাতৃভাষারই একটি অংশ সেই বিষয়টি থেকে আমরা প্রায়শই দূরে সরে যাই। এখানে পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, ‘স্ট্যান্ডার্ড’ বাংলা ভাষার ব্যবহার বা চর্চাকে অপ্রয়োজনীয় বলার উদ্দেশ্য এখানে নেই বরং একেই একমাত্র বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ভাব প্রকাশের ‘সর্বোত্তম’ মাধ্যম হিসেবে যখন ধরা হচ্ছে একই সাথে ব্যক্তি মায়ের থেকে শিখে উঠা আঞ্চলিক মাতৃভাষাকে ‘গেয়ো’, ‘আনস্মার্ট’ হিসেবে ধরার ফলে সেটিকে ছোট করা হচ্ছে। আর এই তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য করার প্রক্রিয়ার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টাকে পরিষ্কার করা যাক- ইংরেজি’ ভাষাকে বলা হয় আন্তর্জাতিক ভাষা। খুব ছোট থেকেই আমাদের ‘ইংরেজি’ ভাষায় পারদর্শী করার চেষ্টা চলে। আমাদের জীবিকার তাগিতেই হোক কিংবা ‘স্মার্ট’ হবার জন্যেই হোক একে রপ্ত করার ফলে যে ঢের সুযোগ-সুবিধা ব্যক্তি পরবর্তী জীবনে ভোগ করে তাতে কোন সন্দেহ নেই একইভাবে শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চাও বেশ প্রয়োজন সেই সাথে অফিশিয়াল নানা কাজে এর চর্চাও হয় যেটাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু এইসব অফিশিয়াল কাজের বাইরেও আঞ্চলিক ভাষা চর্চায় যে অনিহা সেটি কেন আসে? এই উত্তরটাও হয়তো আমাদের সবার জানা- ‘লোকে কি বলবে!’ ভাবতে খুব আশ্চর্য লাগে যখন আপনি দায়বদ্ধতার বাইরে গিয়ে নিজের মতো করে মনোভাব প্রকাশ করবেন সেখানে লোকে কেনো কিছু বলতে যাবে? এই লোকগুলি তো আমাদের বাইরের কেউ না, বরঞ্চ আমরাই। আমার মনে আছে একবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকেই এক বন্ধু আমায় বলে- ‘তোর বাসা কি টাংগাইল?’ আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম সাথে ভালোও লাগলো আরে! সে বুঝলো কিভাবে? তাকে জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিল ‘তোর কথায় তোর এলাকার টান আছে’ আমি জানি না সে কিভাবে কথাটা বললো কিন্তু তাঁর কথার ধরণ আমার কাছে বিষয়টা ব্যাঙ্গাত্নক লেগেছিল।
আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ যে একটি ‘আনস্মার্ট’ প্রক্রিয়া, এটি এমন একটি ডিসকোর্স হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত আছে যে কখনো কখনো আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমনকি ব্যক্তি কোন অঞ্চলের অধিবাসী সেটিও সামনে আনতে চায় না নচেৎ সে ‘আনস্মার্ট’ খেতাবে পড়ে যায়।
অনেক সময় মা-বাবাও সন্তানকে এখান থেকে সরিয়ে রাখতে চায়, তারা চায় তাদের সন্তানও সেরকম ‘স্মার্ট’ বাংলা ভাষার চর্চা করুক যেখানে বাংলা ইংরেজীর মেশানো থাকবে, ‘শুদ্ধ’ উচ্চারণ থাকবে, লোকজন বাহবা দিবে ‘কি স্মার্ট বাচ্চা! কত সুন্দর করে কথা বলে’। অন্যদিকে কোনোভাবে যদি সন্তান আঞ্চলিক ভাষার কিছু শব্দ রপ্ত করে ফেলে সাথে মা- বাবার মনে ভয় ঢুকে যায় তাকে বলা হয় – ‘ঠিক করে কথা বলো’, ‘তুমি কি বস্তির ছেলে?’ এখানে ‘ঠিক করে কথা বলো’ মানে বোঝানো হচ্ছে তুমি যে ভাষা ব্যবহার করলে এটা ভুল, এটি সঠিক না। একইভাবে ‘বস্তির ছেলে’ এমন একটা নেতিবাচক ইমেজ এর সৃষ্টি করলো যার বিপরীতে ‘ভালো ছেলেপুলেরা’ যে এমন ভাষা ব্যবহার করে না সেটি ইঙ্গিত করা হলো। এই মন্তব্য গুলো ঐ শিশুটির মধ্যে একই চিন্তন পুনরায় গঠন করে অর্থাৎ সমাজে বিদ্যমান ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ভাষার ডিসকোর্স নিয়ে সে পুনরায় বেড়ে উঠে। আঞ্চলিক ভাষাকে তুচ্ছ করে দেখার এই প্রবণতার জন্য এর যথাপোযুক্ত চর্চা হয় না, দীর্ঘদিনের চর্চাহীনতার ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে এই আঞ্চলিক ভাষা। ভাষা গবেষকরা আশংকা করেন এভাবে চলতে থাকলে এক সময় নতুন প্রজন্মের কাছে বিলুপ্ত হয় যাবে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার।
আঞ্চলিক ভাষাকে হেয় করে দেখবার এই মানসিকতা বেশ ত্রুটিপুর্ণ। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার কখনো লজ্জার কারণ হতে পারে না। ব্যক্তির কর্ম ক্ষেত্র তাকে কোন ভাষার মাধ্যম ব্যবহারে উৎসাহিত করছে সেটি যেমন আলাদা একই ভাবে কর্মজীবনের বাইরে গিয়ে ব্যক্তি যদি আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পায় তাতেও লজ্জার কিছু নেই। আঞ্চলিক ভাষাও সংস্কৃতির একটা অংশ। বাঙ্গালীদের আঞ্চলিক ভাষাতেও রয়েছে বিখ্যাত গান, কবিতা, নাটকসহ নানান কিছু। কোন সংস্কৃতির অংশকেই ছোট করে দেখার, তাচ্ছিল্য করার অধিকার আমাদের নেই। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার তাই স্বাধীনভাবে হওয়া প্রয়োজন, সেই সাথে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এর চর্চা বহাল থাকুক নতুন প্রজন্মের কাছেও। তাঁরা জানুক বাংলা ভাষায় কত বৈচিত্র্য রয়েছে, তারা সম্মান দিতে শিখুক সকল ধরণের ভাষা-ভাষীর জনগোষ্ঠিকে, রক্ষা করুক এই বিলুপ্তপ্রায় ভাষার চর্চাকে।
সর্বোপরি মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হোক উন্মুক্ত!
১ম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- আধুনিকতার ফলশ্রুতিতে বিলুপ্তিঃ বিলুপ্তির পথে যেই শিল্প ও সম্প্রদায়

লেখকঃ
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
যোগাযোগঃ afiashanta12@gmail.com
The writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.
If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com