মাইগ্রেশন বা অভিবাসন, অর্থাৎ মানুষের একটি স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর, মানব ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতীতে মানুষের স্থানান্তর মূলত প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক কারণে ছিল, কিন্তু আধুনিক যুগে অভিবাসনের নানা ধরনের কারণ ও তাৎপর্য তৈরি হয়েছে। অ্যানথ্রোপলজি, যা মানব সমাজ এবং সংস্কৃতির গভীর বিশ্লেষণ করে, মাইগ্রেশন এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত গতিশীলতা ও ট্রান্সন্যাশনালিজম (আন্তর্জাতিকতার উন্মেষ) নিয়ে গভীর গবেষণা করেছে। মাইগ্রেশন শুধু ব্যক্তিগত জীবন বা পেশাগত পরিবর্তন নয়, এটি একটি বৃহৎ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া যার ফলস্বরূপ নতুন জনগণের সংমিশ্রণ, সংস্কৃতির বিকাশ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে।
মানব গতিশীলতা এবং ট্রান্সন্যাশনালিজমের অ্যানথ্রোপলজিক্যাল বিশ্লেষণ মূলত দুইটি ক্ষেত্রকে সামনে নিয়ে আলোচনা করে—একটি হলো অভিবাসনের প্রক্রিয়া এবং তার ফলস্বরূপ মানব সমাজে সংস্কৃতির মিশ্রণ এবং দ্বিতীয়টি হলো অভিবাসী মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং সেই পরিচয় কীভাবে নতুন দেশে বা অঞ্চলে বিকশিত হয়। আধুনিক যুগে, বিশেষ করে বিশ্বায়নের যুগে, মাইগ্রেশন এবং ট্রান্সন্যাশনালিজম একটি নতুন আঙ্গিকে দেখা দিচ্ছে যেখানে মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে গেলেও তাদের শিকড়, সংস্কৃতি এবং যোগাযোগের সম্পর্ক পূর্ববর্তী দেশের সঙ্গে অক্ষুণ্ণ থাকে।
মাইগ্রেশন বিভিন্ন কারণে ঘটে থাকে—যেমন উন্নত জীবনের সন্ধানে, রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য, অর্থনৈতিক কারণে, শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে, বা পরিবেশগত সংকটের কারণে। মাইগ্রেশন যে শুধু একটি দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাওয়া নয়, বরং এটি আঞ্চলিক এবং আন্তঃদেশীয় পর্যায়ে ঘটতে পারে। এভাবে, মাইগ্রেশন সমাজে এবং সমগ্র বিশ্বের সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, এবং এটি দেশের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতি পরিবর্তন করে। অ্যানথ্রোপলজি এই প্রক্রিয়া এবং তার পরিণতির উপর গভীর নজর দেয়, বিশেষ করে কিভাবে অভিবাসী জনগণ তাদের পুরানো দেশে অথবা নতুন দেশে নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রাখে এবং তার সাথে দেশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটায়।
ট্রান্সন্যাশনালিজম (Transnationalism) এমন একটি ধারণা যা মানুষের একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক এবং যোগাযোগকে নির্দেশ করে। এটি ১৯৯০-এর দশকে গড়ে ওঠে, যখন বিশ্বব্যাপী অভিবাসনের হার বৃদ্ধি পায় এবং মানুষ শুধুমাত্র এক দেশে বসবাস না করে বরং একাধিক দেশের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ট্রান্সন্যাশনালিজমের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, অভিবাসী ব্যক্তিরা তাদের পুরানো দেশ এবং নতুন দেশের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক তৈরি করে, যেখানে তারা একাধিক পরিচয়ে জীবনযাপন করে এবং দুই বা ততোধিক সংস্কৃতির সঙ্গে মেলামেশা করে।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন কর্মসংস্থানে কাজ করার জন্য চলে আসছে। ভারতীয় অভিবাসীরা শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব দেশের সংস্কৃতিকে তাদের নতুন দেশে নিয়ে যায় না, বরং তারা স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গেও মিশে যায় এবং নতুন একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় তৈরি করে। তবে তাদের সম্পর্ক এবং যোগাযোগ, যেমন আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি সহানুভূতি, ব্যবসায়িক সম্পর্ক, এবং সামাজিক নেটওয়ার্কগুলি, তাদের পুরনো দেশে অবিচ্ছিন্নভাবে বজায় থাকে। তারা ফোন, ইন্টারনেট, অর্থপ্রেরণ (remittances) এবং সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে নিজেদের পুরনো দেশে যোগাযোগ রাখে। এই প্রক্রিয়া তাদের জীবনের অংশ হয়ে ওঠে এবং এটি তাদের অভিবাসী জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে দাঁড়ায়।
অ্যানথ্রোপলজি অব মাইগ্রেশন এবং ট্রান্সন্যাশনালিজমের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো মেক্সিকান অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে। মেক্সিকোর দারিদ্র্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে, বহু মেক্সিকান নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে কাজের জন্য চলে আসেন। যদিও তারা নতুন দেশে বসবাস করছেন, তারা তাদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মেক্সিকান পরিবার তাদের পুরনো দেশে অর্থ পাঠায়, যেমন অনেকে তাদের গ্রামে বাড়ি তৈরি করতে সাহায্য করে বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে। তারা একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন পরিচয় এবং সামাজিক মর্যাদা তৈরি করছে, যা তাদের আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক অবস্থান বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ফোরেনসিক অ্যানথ্রোপলজি, অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন অংশের সম্পর্কিত মানুষদের গবেষণাও এই অভিবাসন এবং ট্রান্সন্যাশনালিজমের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, মাইগ্রেশন শুধুমাত্র মানুষের স্থান পরিবর্তন নয়, বরং এটি তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটায়। অভিবাসীরা তাদের পূর্ববর্তী দেশে এবং নতুন দেশে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালন করে, যা তাদের সামগ্রিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। তারা মাঝে মাঝে উভয় দেশেই নিজেদের সমন্বিত সংস্কৃতির মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখে, যে ভারসাম্য তাদের অনুভূতি, আচরণ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, এবং ঐতিহ্যগুলির মধ্যে সমন্বয় ঘটায়।
একটি গভীরভাবে গবেষণালব্ধ উদাহরণ হলো বাংলাদেশী অভিবাসী পরিবারের গল্প। বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকে এবং ২০০০-এর দশকে, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে বহু বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করতে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং তাদের জীবিকা সেখানে আয়ের জন্য ছিল। তবে, তারা তাদের দেশের মধ্যে তাদের সম্পর্ক বজায় রেখেছে। পরিবারের সদস্যরা বাড়ির জন্য অর্থ পাঠিয়েছে, দেশে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে এবং সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে নিজেদের পুরনো সংস্কৃতি অনুসরণ করেছে। একই সঙ্গে, তারা সেখানে নতুন কর্মসংস্থান এবং সামাজিক স্তরে উন্নতি লাভ করেছে। বাংলাদেশী অভিবাসীদের এই জীবনযাত্রা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্যে দুইটি ভিন্ন জগতের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে, এবং এটি ট্রান্সন্যাশনালিজমের প্রকৃত উদাহরণ।
এছাড়াও, ট্রান্সন্যাশনালিজমের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো। অনেক দেশে অভিবাসীদের নিয়ে আইন তৈরি হয় এবং তা তাদের অধিকার রক্ষায় সহায়ক হয়। তবে, অনেক সময় অভিবাসীরা বৈষম্য, সামাজিক অস্থিরতা এবং শোষণের শিকার হয়, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে, আন্তর্জাতিক সমঝোতা এবং অভিবাসী অধিকার রক্ষা আইনগুলির গুরুত্ব বেড়ে যায়।
সামগ্রিকভাবে, মাইগ্রেশন এবং ট্রান্সন্যাশনালিজম অ্যানথ্রোপলজি দ্বারা বিশ্লেষিত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা শুধু অভিবাসীদের জীবন যাত্রা এবং অভিজ্ঞতাই নয়, বরং বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটাতে সহায়ক। মানুষ যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হয়, তখন তা শুধুমাত্র স্থানীয় সমাজে নয়, বরং বিশ্বব্যাপী মানবিক সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এই প্রক্রিয়া এবং তার ফলাফল, অ্যানথ্রোপলজির গবেষণার মাধ্যমে আমাদের কাছে একটি বৃহত্তর বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি এনে দেয়, যা মানব ইতিহাস এবং সমাজের বৈচিত্র্য বোঝার জন্য অপরিহার্য।